ব্লাড ক্যান্সার কি
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠকবৃন্দ। ক্যান্সার একটি মরণব্যধি হিসেবে আমরা বহুকাল ধরে জেনে আসছি। কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত হয়েছে। তাই এখন ব্লাড ক্যান্সার এখন আর মরনব্যধি নয় বরং সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে চিকিৎসা করলে ব্লাড ক্যান্সার থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আজকে আমাদের আলোচনা মূল আলোচনার বিষয় হচ্ছে ব্লাড ক্যান্সারের ওষুধ ও চিকিৎসায় এবং ব্লাড ক্যান্সার থেকে মুক্তির উপায়। কিন্তু চিকিৎসা নিয়ে আলোচনার পূর্বে আমাদের ব্লাড ক্যান্সার কি এবং কিভাবে হয় তা নিয়ে পরিষ্কার ধারনা থাকা আবশ্যক।
ব্লাড ক্যান্সার কি?
মানব শরীরে মূলত তিন ধরনের রক্ত কণিকা থাকে। রেড ব্লাড সেল বা লোহিত রক্ত কণিকা, হোয়াইট ব্লাড সেল শ্বেত রক্ত কণিকা এবং প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকা। এই রক্তকণিকাগুলো অস্থিমজ্জার ভেতরে তৈরি হয় এবং শিরা – উপশিরার মাধ্যমে সমস্ত শরীরে প্রবাহিত হয়। ব্লাড ক্যান্সার মূলত অস্থিমজ্জার ভেতরে হোয়াইট ব্লাড সেল বা শ্বেত রক্তকণিকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।
ব্লাড ক্যান্সার কেন হয়
ব্লাড ক্যান্সার কেনো হয় এর সঠিক ধারনা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে দীর্ঘদিন গবেষনার পর ডাক্তাররা কিছু ধারনায় উপনীত হতে পেরেছেন যা আমরা নিচে উল্লেখ করবো। ব্লাড ক্যান্সার মূলত লোহিত রক্ত কণিকায় হয়ে থাকে। যেকোন বয়সের মানুষের যেকোন সময় এই ধরনের রোগ হতে পারে তবে দেখা গেছে বড়দের তুলনায় শিশুদের এই রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশি। শিশুদের ব্লাড ক্যান্সার, থ্যালাসেমিয়ার মত রোগ গুলো হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি থাকে।
যেমনটা আমরা উপরে বলেছি ব্লাড ক্যান্সার হওয়ার নির্দিষ্ট কোন কারন এখনো জানা যায়নি তবে কিছু কিছু বিষয় আছে যা ব্লাড ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। যেমন
- ক্ষতিকর রেডিয়েশন
- ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ
- ফরমালিন বা ভেজাল যুক্ত খাবার নিয়মিত খাওয়া
- ক্ষতিকর কিটনাশক
- ক্যামোথেরাপীক ড্রাগস
ব্লাড ক্যান্সার কত প্রকার
ব্লাড ক্যান্সার কি এবং ব্লাড ক্যান্সার কি কি কারনে হয় বা হতে পারে তা তো জানলাম। এখন আমরা এক নজরে দেখে নেই ব্লাড ক্যান্সার কত ধরনের হতে পারে।
মেডিকেলের ভাষায় মানব দেহে মূলত দুই ধরনের ব্লাড ক্যান্সার হতে পারে।
- একিউট (Acute)
- ক্রনিক (Chronic)
একিউট ব্লাড ক্যান্সার মূলত বাচ্চাদের হয় এবং এই ধরনের ব্লাড ক্যান্সার দ্রুত ও সহজে নিরাময় যোগ্য। আর ক্রনিক হচ্ছে তুলনামূলক জটিল ধরনের ব্লাড ক্যান্সার যা সহজে নিরাময় যোগ্য নয় এবং এর চিকিৎসা তুলনামূলক সময় সাপেক্ষ।
আকিউট ব্লাড ক্যান্সারকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়:
- Acute Lymphoblastic Leukaemia
- Acute Lymphocytic Leukaemia
একইভাবে ক্রনিক ব্লাড ক্যান্সারকেও মেডিকেলের ভাষায় দুইভাগে ভাগ করা যায়
- Chronic Lymphocytic Leukaemia
- Chronic Myclaid Leukaemia
প্রতিটা ব্লাড ক্যান্সারের ধরন ও চিকিৎসায সম্পূর্ন ভিন্ন। আমরা নিচে কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করবো। তবে যেহেতু এইসব মেডিকাল টার্ম আমরা শুধু আপনাদের একটা ধারনা দেয়ার চেষ্টা করবো মাত্র। ক্যান্সারের ধরন শুধুমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমেই জানা সম্ভব।
ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণ
যেমনটা আমরা ইতঃপূর্বে বলেছি ব্লাড ক্যান্সারের কেনো হয় তা এখনো সুনির্দিষ্ট করে বলা কিছুটা কষ্টকর। ডাক্তাররা শুধু একটা ধারনা করতে পারেন মাত্র তবে নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তবে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে যা দেখে আপনি কিছুটা ধরনা করতে পারবেন রোগীর ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে অথবা ব্লাড ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডাক্তাররা বরাবর ই বলে থাকেন প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করতে পারলে রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়। তাই চলুন এক নজরে ব্লাড ক্যান্সারের কিছু কমন ও সম্ভাব্য লক্ষন দেখে নেয়া যাক।
- শরীরে অস্বাভাবিকভাবে রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়া ও রক্ত স্বল্পতার কারনে শরীর দূর্বল হয়ে যাওয়া।
- খাবারে অরুচি ও নিয়মিত মুখে খাবার দিলে বমি আসা।
- অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ। বিশেষ করে নাক, মুখ ও মলদ্বার দিয়ে রক্ত ক্ষরণ হওয়া।
- দীর্ঘদিন জ্বর ও দীর্ঘ সময়ের জন্য জ্বর।
- পায়ে পানি জমে যাওয়া ও হাড় ব্যথা করা।
- ওজন কমে যাওয়া।
- মাড়ি থেকে রক্তপাত হওয়া।
কারো কারো ক্ষেত্রে দুই একটি ও কারো কারো ক্ষেত্রে প্রায় সবগুলো লক্ষন একসাথে দেখা দিতে পারে। এইসব লক্ষন দেখা দিলেই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। দ্রুত নিকটস্থ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করুন এবং তিনি আপনাকে পরবর্তী স্টেপ সম্পর্কে নির্দেশনা দিবেন। আর এই সকল লক্ষন দেখা দিলেই রোগীর ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে তাও বলা যাবে না কারন ক্যান্সার ছাড়াও অন্য রোগের ক্ষেত্রে ও এইরকম লক্ষন দেখা দিতে পারে।
ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা
অনেকেই জানতে চেয়েছেন ব্লাড ক্যান্সার রোগ ধরা পড়লে কি রকম চিকিৎসা দেয়া হয় অর্থাৎ চিকিৎসা পদ্ধতি কি। ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে মূলত ব্লাড ক্যান্সারের ধরনের উপর। চিকিৎসা শুরু পূর্বে রোগীকে লম্বা সময়ের জন্য পর্যবেক্ষনে রাখা হয় এবং তার শারীরিক অবস্থা ও ক্যান্সারের ধরন ও কোন পর্যায়ে আছে এই সব কিছু বিবেচনা করে চিকিৎসা শুরু করা হয় যা তুলনামূলক ঝটিল ও লম্বা পদ্ধতি।
তবে কিছু সাধারন চিকিৎসা পদ্ধতি আছে যা আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করতে পারি। সাধারনত ব্লাড ক্যান্সারের জন্য ক্যামো থেরাপী, রেডিয়েশন থেরাপী, টার্গেটেড থেরাপী ও অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন এর মত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়।
- কেমোথেরাপিতে, ক্যান্সারের প্রভাব কমাতে ড্রিপ ব্যবহার করে IV ওষুধ দেওয়া হয়। যদিও ক্যামোথেরাপি মূলত দেয়া হয় ক্যান্সার কোষগুলোকে দূর্বল করার জন্য বা সম্পূর্ন ধ্বংশ করার জন্য কিন্তু দীর্ঘদিন কেমোথেরাপীর প্রভাবে শরীরের সুস্থ কোষগুলো ও কিছুটা প্রভাবিত হয়। যার কারনে চুল পড়ে যায়, স্বাস্থ কমে যায়, মুখের রুচি কমে যায়।
- এছাড়া লেজার থেরাপি সরাসরি ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে কাজ করে ও ক্যান্সার কোষগুলোকে মেরে ফেলে।
- জৈবিক থেরাপি নামে এক বিশেষ ধরনের থেরাপী বর্তমানে ব্যবহার করা হয় যার সাহাযে শরীরের নরমাল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাহায্যেই ক্যান্সার কোষ ধ্বংশ করা যায়। এক্ষেত্রে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে এক্টিভ করা হয়। এটি একটা দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি কিন্তু শরীরের ক্ষতি কম হয় এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
- অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন হচ্ছে ব্লাড ক্যান্সারের সবচেয়ে কার্যকরী এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসা। এক্ষেত্রে রোগী সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। অস্থিমজ্জার যে অংশ ক্যান্সার সেল উৎপন্ন করার জন্য দ্বায়ী অপারেশনের মাধ্যমে অই অংশ প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে রোগী অনেক সুস্থ হয়ে যান। তবে এক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্য্য অনেক বেশি হতে পারে।
ব্লাড ক্যান্সার থেকে মুক্তির উপায়
অনেকে জানতে চান ব্লাড ক্যান্সার থেকে মুক্তির উপায় কি। প্রথম কথা হচ্ছে যেহেতু এই রোগের সঠিক কারন এখনো অজানা তাই স্পেসেফিকভাবে বলা কঠিন। তবে আপনি যদি সুস্থ থাকা অবস্থায় ই সচেতন থাকতে চান তাহলে আমাদের সাজেশন থাকবে পরিমিত ও নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহন। নিয়মিত ডাক্তারের কাছে চেকাপ সহ উপরের উল্লেখিত ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষন সমূহ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার দেখানো। এইসব বিষয় খেয়াল রাখলে আশা করা যায় ব্লাড ক্যান্সার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা খরচ
ব্লাড ক্যান্সারের খরচ নির্ভর করে চিকিৎসার ধরন ও রোগীর অবস্থার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রকম হতে পারে। এছাড়া কোন ধরনের হাসপাতালে চিকিৎসা হচ্ছে তারউপর ও খরচের ব্যাপারটা নির্ভর করে। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে আমাদের দেশে সরকারি হাসপাতাল গুলোতেই ভালো চিকিৎসার দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ লক্ষ টাকার মধ্যে চিকিৎসা হয়ে যাবে।
তবে যদি ব্লাড ক্যান্সারের ধরন জটিল হয় এবং অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মত ঝটিল অপারেশন করতে হয় তাহলে প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি হতে হবে এবং সেক্ষেত্রে খরচের পরিমান টা ১০ থেকে ১২ লক্ষ টাকার মত পড়ব।
ব্লাড ক্যান্সার কি ছোঁয়াচে
অনেকের ধারনা ছিলো যেহেতু এটা ব্লাডের মাধ্যমে ছড়ায় তাই এটা হয়তো হেপাটাইটিস এর মত ছোঁয়াচে। তবে গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন ব্লাড ক্যান্সার কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। তাই রোগীর সেবা করার মাধ্যমে বা বিছানা শেয়ার করার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায় না। তবে আক্রান্ত রোগীর শরীরের রক্ত অন্য কোন সুস্থ মানুষের শরীরে দেয়া যাবে না।
ব্লাড ক্যান্সার হলে মানুষ কতদিন বাঁচে
যেমনটা আমরা উপরে আলোচনা করেছি ব্লাড ক্যান্সারের বিভিন্ন ধরন ও স্টেজ রয়েছে। তাই রোগীর কন্ডিশনের উপর ও চিকিৎসার ধরনের উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। সাধারনভাবে যদি প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নেয়া যায় তাহলে ক্যান্সার থেকে ৮০% পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া যায়। তবে ক্রিটিকাল পর্যায়ে চলে গেলে ৬ মাসের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
ব্লাড ক্যান্সারের হোমিও চিকিৎসা
সেই প্রাচীনকাল থেকে পৃথীবির বিভিন্ন দেশে হোমিও বা ভেসজ চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত হয়ে আসছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ভেসজ চিকিৎসা পদ্ধতি নিসন্দেহে অনেক ভালো কাজ করে তবে ব্লাড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে হোমিও চিকিৎসা না নেয়ার জন্য ডাক্তাররা বলে থাকেন। কারন এই রোগ হোমিও চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো হওয়ার মত রোগ নয়। তাই দয়া করে ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষন দেখা দিলে হোমিও ডাক্তারের কাছে না গিয়ে দ্রুত রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন।