শিশুর নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ
নিউমোনিয়া হচ্ছে ফুসফুসের সংক্রমন জনিত একটি রোগ। সাধারণত ফুসফুসের বায়ুথলির পুজ বা পানি দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে গেলে নিউমোনিয়া রোগ হয়। প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশুর নিউমোনিয়া বেশি হয়ে থাকে তাই পূর্ব থেকেই সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত।
আজকে আমরা শিশুর নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
নিউমোনিয়া কি
ফুসফুসের এক ধরনের ইনফেকশন এর নাম হলো নিউমোনিয়া। সাধারনত শ্বাসতন্ত্র বিশেষ করে ফুসফুসে সমস্যার জন্য নিউমোনিয়া হয়ে থাকে। নিউমোনিয়ার ইংরেজি প্রতিশব্দ হল রেস পাইরেটরি ইনফেকশন। এই সমস্যা যখন জীবাণু ঘটিত বা সংক্রমণ জনিত রোগে তৈরি হয় তখন এটাকে নিউমোনিয়া বলে।
সাধারনত প্রাপ্ত বয়ষ্কদের তুলন্য শিশুদের এই রোগ বেশি হয়ে থাকে তাই আজকে আমরা শিশুর নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
শিশুর নিউমোনিয়া রোগের কারণ
নিউমোনিয়া রোগের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। সর্দি-কাশি বাচ্চাদের একটি কমন রোগ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সর্দি কাশি যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে তখন নিউমোনিয়ার রূপ নেয়। নিউমোনিয়া রোগের কারণ গুলো জানা থাকলে সাবধানতা অবলম্বন করা যায়।
ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মনে হয় সেগুলো হলো-
- স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি
- এডেনো ভাইরাস
- ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস
- প্যারা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস
নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ
শিশু নিউমোনিয়ার অনেকগুলো লক্ষণ রয়েছে। যেহেতু নিউমোনিইয়া একটি ফুসফুসের ইনফেকশনের নাম । সুতরাং নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে জড়িত।
- নিউমোনিয়া হলে প্রথমে তীব্র আকারে জ্বর থাকবে।
- ক্লান্তি ভাব অনুভব করা।
- মাত্রা অতিরিক্ত ঘামানো।
- কাশি হওয়া।
- বুক ব্যাথা করা।
- শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হওয়া।
- মাথাব্যথা হওয়া।
- শরীরের মাংসপেশিতে ব্যথা থাকা।
- খাওয়ার প্রতি অনিহা থাকা।
- বমি হওয়া।
- নিঃশ্বাস নেওয়ার গতি বেড়ে যাওয়া।
- নিশ্বাস নেওয়ার সময় বুকের খাঁচা নিচের দিকে ডুবে যায়।
কিভাবে নিউমোনিয়া ছড়ায়
নিউমোনিয়া সাধারণত সর্দি কাশির মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের হতে পারে। সাধারণত সর্দি এবং কাশিতে থাকা জীবানু বাতাসের মাধ্যমে এর রোগ ছড়াতে পারে। তাই নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর সাথে সাথেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত। নিউমোনিয়া থেকে বাঁচতে জানতে হবে এটি কিভাবে ছড়ায়।
সাধারণত বাচ্চাদের নাকে যে সব জীবানু থাকে সেগুলো ফুসফুসে নেমে গিয়ে প্রদাহ তৈরি করতে পারে । সেই প্রদাহ থেকে নিউমোনিয়া হতে পারে।নিউমোনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশি থেকে বের হওয়া রেশমা স্লেশ্মার মাধ্যমে ছড়াতে পারে।
আরো পড়ুন – শিশুর পাতলা পায়খানার ঔষধ – বাচ্চার ডায়রিয়া হলে করনীয়
নিউমোনিয়া নির্ণয়ের পরীক্ষা বা টেস্ট
সাধারণত নিউমোনিয়া টেস্টের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া টেস্ট করতে হয়। তবে ব্লাড টেস্টের মাধ্যমে নিউমোনিয়া নির্ণয় করা যায়। শিশুর নিউমোনিয়া সনাক্তের জন্য ডাক্তাররা নিম্নের টেস্টগুলো দিয়ে থাকেন –
- সিবিসি
- ডব্লিউবিসি
- এবিজি
- এএফবি
শিশুকে নিউমোনিয়া থেকে বাঁচাতে করণীয়
বর্তমানে নিউমোনিয়ার কিছু ভ্যাকসিন রয়েছে। সময় মত ভ্যাকসিনগুলো বাচ্চাদের জন্য নেয়া অনেক উপকারী ।তাহলে শরীরে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস জনিত নিউমোনিয়া হবে না। বরং তা প্রতিরোধ করার মতো শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। তবে তা দেওয়ার পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- শিশুকে নিউমোনিয়ার টিকা সহ জন্মের পর সবগুলো টিকা দেওয়া।
- শিশুকে নিউমোনিয়া আক্রান্ত অন্য শিশুর কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে কারণ নিউমোনিয়া হাঁচি কাশি মাধ্যমে ছড়ায়।
- শিশুকে সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় রাখতে হবে।
- বাইরে থেকে এসে হাতমুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলার অভ্যাস করতে হবে।
- এছাড়া খাবার খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে।
- শিশুর বয়স ছয় মাসের কম হলে মায়ের বুকের দুধ প্রচুর পরিমাণে খাওয়াতে হবে।
- বাচ্চার বয়স ছয় মাসের বেশি হলে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবার খাওয়াতে পারলে সবচেয়ে বেশি উপকার হয়।
- গরমে সুতি কাপড় এবং শীতের শীতের উপযোগী পোশাক পরতে হবে।
- সর্দি কাশি হলে সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
শিশুর নিউমোনিয়া রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা
ফুসফুসের কোন অসুখ হলে তাড়াতাড়ি চলে যায় না ।এ অবস্থা থেকে সুস্থ হতে প্রায় এক সপ্তাহ থেকে এক মাসও লাগতে পারে। তবে নিউমোনিয়া ধরনের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসকরা ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন।সাথে সাথে কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করেও এ অসুস্থতা থেকে সুস্থতা লাভ করা যায় ।
তরল খাবার – সুস্থ থাকলেও শরীরকে সতেজ রাখতে একজন মানুষের প্রচুর পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার খেতে হয়। অসুস্থ অবস্থায় এর গুরুত্ব আরো অনেক গুণ বেড়ে যায়। তাই চিকিৎসকের মতে তরল জাতীয় খাবার ফুসফুসের শ্লেষ্মা বের করে দিতে অনেক সাহায্য করে। তাই নিউমোনিয়া হলে পানি ও গরম সুপ ভালো কাজ করে ।
ক্যাফিন এবং অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকা – সাধারণত ক্যাফিন এবং অ্যালকোহল শরীরের অনেক ক্ষতি করে আর অসুস্থ অবস্থায় নিউমোনিয়া হলে অ্যালকোহল শরীরকে আরো দুর্বল করে দেয়। সাধারণ সময়ে এগুলো শরীরকেডি হাইড্রেট করতে পারে তাই এগুলো থেকে দূরে থাকা উচিত।
লেবু ও মধু – কাশি হলে অনেকে কাশির সিরাপ সেবন করে থাকেন কিন্তু মনে রাখতে হবে কাশি হলে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শরীর ফুসফুসের শ্লেষ্মা বের করে দিতে চেষ্টা করে। তাই খুব প্রয়োজন না হলে কাশির সিরাপ খাওয়া যাবেনা কাশির মাত্রা বেশি হলে লেবু ও মধুর মিশ্রণ পান করা যায়।
গরম ভাপ – নিউমোনিয়া হলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় তাই গরম ভাপে আরাম পাওয়া যেতে পারে। কুসুম গরম পানিতে একটি কাপড় ভিজিয়ে কপাল বা ঘাড়ের উপর ২০ থেকে ৩০ মিনিট রেখে দেওয়া যায়।
ব্যথার ঔষধ – শরীর অতিরিক্ত ব্যথা হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে কারণ বাচ্চাদের শরীরে ব্যথার কারণে অ্যান্টিবায়োটিক অবশ্যই দিতে হয়। তবে এন্টিবায়োটিক দিলে তা অবশ্যই কোর্স সম্পূর্ন করতে হবে।
সঠিকভাবে কাশি দেয়া – চেয়ারে বসে সামান্য ঝুঁকে কয়েকবার জোরে জোরে কাশলে বুকের ভেতর জমে থাকে শ্লেষ্মা বা কফ বের হয়ে যায়। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার কাশি দিলে শরীরের জন্য উপকার হতে পারে।
হলুদ – দক্ষিণ এশিয়ায় শত শত বছর ধরে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা ব্যাথার চিকিৎসায় এ মসলাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে ।গবেষণায় দেখা গেছে নিউমোনিয়া কমানোর জন্য হলুদ কার্যকর ভূমিকা রাখে। হলুদের পরিবর্তে হলুদ চা পান করা যেতে পারে তবে সতর্ক থাকতে হবে হলুদ খেলে পেট খারাপ হতে পারে।
নিউমোনিয়া কখন ও কোন বয়সী বাচ্চাদের হয়
সাধারণত নিউমোনিয়া গরমের চাইতে শীতের সময় বেশি লক্ষ্য করা যায় প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের নিউমোনিয়া রোগ বেশি লক্ষ্য করা যায় ০ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত বয়সের শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে বলে নিউমোনিয়া হয়।
তবে অসচেতন থাকলে যেকোন বয়সের বাচ্চাদের ই এই রোগ হতে পারে। বিশেষ করে শীত কালে এই রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়।
শিশুর নিউমোনিয়া ঝুকিমুক্ত রাখার উপায়
- শিশুর জন্মের প্রথম ছয় মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো কেননা বুকের দুধের মধ্যে অনেক রোগের এন্টিবায়োটিক তৈরি করা আছে।
- ছয় মাসের পর বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার খাওয়ালে শিশুদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় যার ফলে নিউমোনিয়া হয় না।
- শিশুদের ঘন ঘন সর্দি হওয়া থেকে দূরে রাখা।
- শিশুকে নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগের টিকা দেওয়া।
- দরজা জানালা ঘর ধুলাবালি থেকে মুক্ত রখা।
- ঘনঘন ভাবে হাত ধোয়া।
- সব সময় হাঁচি বা কাশি দেওয়ার পূর্বে হাত দিয়ে মুখ ঢাকা।
- ভালোভাবে হাত না ধুয়ে চোখ নাক কান স্পর্শ না করা।
- বাসায় ধূমপান না করা।
- যাদের সর্দি বা কাশি রয়েছে তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
শিশুর নিউমোনিয়া রোগের ঔষধ কি
সাধারণত ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত কোনো ঔষধ গ্রহন করা উচিত নয়। শিশুর ক্ষেত্রে অবশ্যই কোন ঔষধ বা সিরাপ খাওয়ানোর পূর্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। শরীরের জ্বর বা ব্যথা থাকলে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়াতে হবে । প্যারাসিটামল পরিবর্তে প্রোফেন সেবন করানো যায় না।
কিন্তু শিশুদের কখনো অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ খাওয়ানো যাবে না। অ্যাসপিরিন ব্যবহারের ফলে শিশু মারাত্মক অসুস্থ হতে পারে। দু বছরের কম শিশুদের আইবুপ্রোফেন সেবন করানো যাবে না।
হসপিটালে ভর্তি
সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের নিউমোনিয়া হলে তা প্রথম থেকে থেকে ততটা মারাত্মক হয় না ।কিন্তু শিশুর নিউমোনিয়া হলে এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের নিউমোনিয়া হলে তা তাদের জন্য মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
বিশেষ কিছু শিশুর নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে। যেমন –
- শিশুদের তীব্র জ্বর ও বমি
- শরীরে পানিশূন্যতা
- শরীর নিস্তেজ হতে দেখা গেলে
- কাশির সময় কফের সাথে রক্ত গেলে
মন্তব্য
শিশুর নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে উপরে আমরা একটি আর্টিকেল শেয়ার করেছি। আশা করছি দৈনন্দিন জীবনে অনেক কাজে লাগবে। সম্পর্কে আপনাদের কোন মতামত থাকলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। আমরা অতি দ্রুত কমেন্টের রিপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করব।
আরো পড়ুন –