রুকাইয়া কি?
আসসালামু আলাইকুম বন্ধুরা। ঝাড়ফুঁক কিংবা তাবিজ কবচের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। আর আমরা এটাও জানি ইসলামী তাবিজ করা কিংবা মন্দ উদ্দেশ্যে ঝাড়ফুঁক করাও হারাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই জানি না ইসলামী নিইয়ম মেনেই আপনি বিভিন্ন সমস্যার জন্য রুকাইয়া নামক বিশেষ পদ্ধতিতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে পারবেন। এক্ষেত্রে এটা কোন তাবিজ বা ঝাড়ফুঁক নয় বরং পবিত্র কুরানে ও হাদিসে উল্লেখিত কিছু নিয়ম ও দোয়া পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া হয়।
রুকাইয়া শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ঝাড়ফুঁক বা তাবিজ কবচ ইত্যাদি। তবে প্রচলিত ঝাড়ফুঁক ও তাবিচ কবচ থেকে কিছুটা ভিন্ন। রুকাইয়া মূলত কুরানের কিছু বিশেষ আয়াত ও হাদিসে নবী করিম সাঃ এর শিখানো কিছু দোয়া অথবা বিভিন্ন তাবে তাবিয়িনদের শিখনো পদ্ধতিতে শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে কোন বিশেষ সমস্যার সমাধানের জন্য সাহায্য চাওয়াকে বুঝায়। এই ক্ষেত্রে আপনাকে এটা বুঝতে হবে নরমাল তাবিজ কবচ আর রুকাইয়া মোটেই এক নয়। এটা এক বিশেষ ধরনের দোয়া বা ইবাদত। আধুনিক ভাষায় বলতে রুকাইয়া হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের স্পিরিচুয়াল হিলিং পদ্ধতি।
রুকাইয়া কেনো করা হয়
রুকাইয়ার পরিচয় তো জানলাম, এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে রুকাইয়া আসলে কি কি সমস্যার জন্য করা হয়। রুকাইয়া যেহেতু এক বিশেষ ধরনের দোয়া বা ইবাদত তাই আপনি যেকোন ব্যক্তিগত সমস্যার জন্যই রুকাইয়া করতে পারবেন। অর্থাৎ রুকাইয়া যেহেতু মূলত আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার একটি বিশেষ পদ্ধতি তাই আপনি চাইলে যেকোন শারীরিক, পারিবারিক ও মানসিক সমস্যার জন্য রুকাইয়া করতে পারেন। তবে সাধারনত বিভিন্ন জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার জন্য রুকাইয়া করা হয় যেমন হাপানী, শ্বাসকষ্ট, এছাড়াও বিভিন্ন মরনব্যাধী যেমন ক্যান্সার থেকেও মুক্তি পাওয়ার জন্য রুকাইয়া করা হয়।
এক কথায় আপনার যেকোন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার জন্যই আল্লাহর কাছে রুকাইয়ার মাধ্যমে সাহায্য চাইতে পারবেন। তবে রুকাইয়ার কিছু বিশেষ নিয়ম আছে। আপনি কি ধরনের রুকাইয়া করবেন তার উপর নির্ভর করে রুকাই কিভাবে করতে হয় সেটা নির্ধারিত হবে। নিচে আমরা রুকাইয়া কিভাবে করে তা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো ইনশা আল্লাহ।
রুকাইয়া কত প্রকার
রুকাইয়া প্রধানত দুই প্রকারের হয়ে থাকে। প্রথমত আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন জটিল সমস্যা যেমন যাদুটোনা, বদনজর, কালো যাদু এইসবে ভোগেন। এক্ষেত্রে তারা রুকাইয়া করতে অভজ্ঞ এমন বিজ্ঞ আলেম বা হুজুরের কাছে যান। এধরনের রুকাইয়া কিছুটা সময় সাপেক্ষ ও বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে করা হয়।
দ্বিতীয়ত আরক ধরনের রুকাইয়া আছে যা ব্যক্তিগতভাবে নিজে নিজে করে ফেলা যায়। এধরনের রুকাইয়া কে বলা হয় সেলফ রুকাইয়া। এধরনের রুকাইয়ার ক্ষেত্রে আপনার কোন প্রোফেশনাল উস্তাদ বা হুজুরের কাছে যেতে হবে না। আপনি বাসায় বসে নিজেই আপনার সমস্যার জন্য রুকাইয়া করে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রর্থনা করতে পারবেন।
নিচে আমরা রুকাইয়া কিভাবে করে তা নিয়ে বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করবো। আশা করছি এরপর রুকাইয়া করার নিয়ম নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকবে না আপনার মনে।
রুকাইয়া কিভাবে করে
রুকাইয়া যেহেতু একটি বিশেষ নিয়মে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া তাই এই চিকিতসা পদ্ধতি কিছুটা সময় সাপেক্ষ হতে পারে। সেলফ রুকাইয়ার ক্ষেত্রে অর্থাৎ আপনি যদি নিজে নিজে রুকাইয়া করেন সেক্ষেত্রে, হাদিসে উল্লেখিত কিছু দোয়া বিশেষ করে কুরানের কিছু আয়াত বিশেষ নিয়মে নিয়মিত নামাজের পরে পবিত্র অবস্থায় পড়ার মাধ্যমে রুকাইয়া করা হয়।
আর আপনি যদি বিশেষ কোন জটিল সমস্যায় পড়ে যান আর আপনার মনে হয় কোন অভিজ্ঞ রাক্বির (যিনি রুকাইয়া করেন) সাহায্য নিতে পারেন। তবে রাক্বির কাছে সাহায্য চাওয়ার সময় এটা মাথায় রাখতে হবে আপনি মূলত রাক্বির সাহায্যে আল্লাহর কাছে সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্য চাচ্ছেন। রাক্বির কোন সাহায্য নেই আপনাকে সুস্থ করার বা সমস্যা থেক উদ্ধার করার।
নামাজের পর পবিত্র অবস্থায় বসে সাধারনত রুকাইয়া করা হয়। এক্ষেত্রে আপনার হাতকে মোনাজাতের মত করুন তারপর নিচে উল্লেখিত রুকাইয়া আয়াত সমূহ পাঠ করুন। এরপর মুখমন্ডল সহ সমস্থ শরীরে হাত বুলিয়ে নিন। এবং মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তারপর আপনার সমস্যার জন্য মন থেকে সাহায্য চাইতে হবে। রুকাইয়া করার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ জিনিস মনে রাখতে হবে সেটা হলো, আল্লাহর উপর পূর্ন বিশ্বাস সহ সাহায্য চাইতে হবে।
রুকাইয়া করার সময় কুরানের কিছু বিশেষ আয়াত ও সুরা পাঠ করতে হয়। নিচে আমরা রুকাইয়া আয়াত সমূহ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি। আশা করছি এই লিস্ট থেকে দেখে আয়াতসমূহ পাঠ করে রুকাইয়া করলে ভালো ফলাফল পাবেন ইনশা আল্লাহ।
রুকাইয়া আয়াত সমূহ
উপরে আমরা রুকাইয়া কিভাবে করে তা বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করেছি। যেমনয়া আমরা ইতপূর্বে উল্লেখ করেছি রুকাইয়া হচ্ছে বিশেষ ধরনের দোয়া আর দোয়া করার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। অন্যান্য দোয়ার মত রুকাইয়া করার ও কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। এক্ষেত্রে কুরয়ান ও হাদিসের বেশ কিছু নির্দিষ্ট আয়াত আছে যা পাঠ করার মাধ্যমে রুকাইয়া করতে হয়। চলুন তাহলে একনজরে রুকাইয়া আয়াত সমূহ দেখে নেয়া যাক।
- সুরা ফাতিহা ৩ বার/ ৫ বার/ ৭ বার।
- সুরা ইখলাস ৩ বার।
- সুরা ফালাক।
- সুরা নাস।
- সুরা কাফিরুন।
- সুরা বাকারার প্রথম ৫ আয়াত।
- সুরা বাকারার ১৬৩ ও ১৬৪ নং আয়াত।
- সুরা বাকারার ১০২ নম্বর আয়াত।
- সুরা বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াত।
- সুরা বাকারার ২৮৫ ও ২৮৬ নাম্বার আয়াত।
- সুরা আল ইমরানের প্রথম ১০ আয়াত ও ১৮, ১৯ নম্বর আয়াত।
- সুরা ইউনুসের ৮১ ও ৮২ নম্বর আয়াত।
- সুরা আরাফের ৫৪,৫৫ ও ১১৭-১২২ নম্বর আয়াত।
- সুরা ইউনুসের ৮১-৮২ নম্বর আয়াত।
- সুরা আর রহমানের প্রথম ১০ আয়াত।
- সুরা আর রহমানের ৩৩-৩৬ নম্বর আয়াত।
- সুরা হাশরের ২১-২৪ নম্বর আয়াত।
- সুরা জিন ১-৯ নম্বর আয়াত।
- সুরা হাশরের ২১-২৪ নাম্বার আয়াত।
- সুরা সফফত এর ১-১০ নম্বর আয়াত।
রুকাইয়া সাধারনত নামাজের পরে বসে করা হয়। উপরে উল্লেখিত সব আয়াত একসাথে আমল করতে হবে বিষয়টা এমন নয়। প্রত্যেকটি আয়াতের কিছু বিশেষ গুরুত্ব ও বিশেষত্ব রয়েছে। তাই আপনি কি উদ্দেশ্যে রুকাইয়া করতে চান তার উপর কোন আয়াতের উপর বেশি আমল করবেন তা কিছুটা নির্ভর করবে। তবে যত বেশি আয়াত পাঠ করতে পারবেন তত ই ভালো। এক্ষেত্রে কোন লিমিটেশন নেই কারন এটি একটি বিশেষ ধরনের ইবাদাত।
রুকাইয়া করা কি জায়েজ
অনেকেই রুকাইয়া করার ইসলামী বিধান সম্পর্কে জানতে চান। অর্থাৎ রুকায়া করা কি জায়েজ কি না। উত্তর হচ্ছে, হ্যা। রুকাইয়া করা অবশ্যই জায়েজ এবং এটি কুরান ও হাদিস দ্বারা স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। তবে এক্ষেত্রে দুটি বিষয় আপনাকে মাথায় রেখে রুকাইয়া করতে হবে।
- রুকাইয়া করার প্রথম শর্ত হচ্ছে রুকাইয়ার সাথে কালো জাদু বা ঝাড়ফুকের পার্থক্য বুঝতে হবে। কালো যাদু বা ঝাড়ফুক ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু রুকাইয়া কালো যাদু থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন একটি জিনিস।রুকাইয়া মূলত কুরান হাদিসের বিন্ন আয়াত ও দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া। তাই রুকাইয়া ইসলামে হালাল করা হয়েছে এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
- অন্যশর্ত হচ্ছে, রুকাইয়া করার সময় মাথায় এই চিন্তা রাখতে হবে সাহায্য করার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। রাক্বি ( যিনি রুকাইয়া করে দেন) তার কোন ক্ষমতা নেই আপনার সমস্যা সমাধান করে দেয়া। আপনি যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর বিশ্বাস রাখেন সেক্ষেত্রে এটি শিরকে পরিনত হবে। তাই রুকাইয়া করার ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে সাহায্য চাওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা।
কারা রুকাইয়া করতে পারবেন?
আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে কারা রুকাইয়া করতে পারবেন। এই প্রশ্নটি আপনাদের মনে হয়তো সবচেয়ে বেশি ঘুরপাক খায়। এর উত্তর খুবই সরল। যেকেউ রুকাইয়া করতে পারবেন। উপরে আমরা রুকাইয়া কিভাবে করে ও রুকাইয়া আয়াত সমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আপনি চাইলে এই নিয়ম ফলো করে নিজে নিজে বিভিন্ন সমস্যার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে পারেন। এক্ষেত্রে মসজিদের ইমাম ছাড়া রুকাইয়া করা যাবে না এই ধারনা ভুল।
তবে রুকাইয়া যেহেতু বিশেষ পদ্ধতির ইবাদত, ও আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার পদ্ধতি আপনি চাইলে রাক্বির অর্থাৎ বিজ্ঞ কোন হুজুরের সাহায্য নিতে পারেন। মধ্যাকথা হচ্ছে রুকাইয়া যেকেউ ই করতে পারে। এটা করার জন্য বিশেষ কোন শর্ত উল্লেখ করা নেই ইসলামে।
এলার্জি ও সর্দি কাশির জন্য রুকাইয়া
আমরা যেমনটা বলেছি রুকাইয়া আত্মীক সমস্যা থেকে শুরু করে শারীরিক অনেক জটিল সমস্যার ও সমাধানে ব্যবহার করা যায়। উপরে আমরা রুকাইয়া কিভাবে করে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। উদাহরনস্বরূপ আমরা এলার্জি ও সর্দিকাশির জন্য রুকাইয়া করার নিয়ম দেখাচ্ছি। এই নিয়ম ফলো করে আপনি অন্যান্য সমস্যা সমাধানেও রুকাইয়া করতে পারেন। যারা মূলত এলার্জি জনিত হাচি কাশি ও সর্দির সমস্যায় ভোগেন। এছাড়াও এলার্জি জনিত সমস্যার কারনে শ্বাস কষ্ট হয়, এই চিকিতসা মূলত তাদের জন্য।
প্রথমে দুই হাত মোনাজাতের মত করে গোল করে সুরা ফাতিহা বেশ কয়েকবার পড়ুন। সুরা পড়ার ক্ষেত্রে ৩ বার অথবা ৫ বার পড়া শ্রেয়। এরপর হাতের তালুকে অক্সজেন মাস্কের মত মুখে চেপে ধরুন এবং জোরে জোরে নিশ্বাস নিন। এভাবে প্রতি নামাজের পরে এই পদ্ধতি অবলম্বন করার চেষ্টা করুন। আশা করছি আস্তে আস্তে আপনার এলার্জি জনিত সর্দি কাশি ভালো হয়ে যাবে।
রুকাইয়া ও কালোজাদুর পার্থক্য
অনেকেই মনে করেন রুকাইইয়া ইসলামে হারাম কারন এটি ঝাড়ফুক আর কালোযাদুর সাথে সাদৃশ্যপূর্ন। কিন্তু যাদুটোনা আর রুকাইয়া কখনোই এক জিনিস নয়। কালোযাদু কুরান ও হাদিসের বাইরে ও বিভিন্ন মন্ত্র ব্যবহার করা হয় ও দুষ্টু জীন ও শয়তানের পরোক্ষ সহযোগিতায় করা হয়। অন্যদিকে রুকাইয়া হচ্ছে কুরান ও হাদিসের আলোকে বিভিন্ন দুয়া ও আয়ত পাঠের মাধ্যমে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। তাই এটা মাথায় রাখতে হবে কালো যাদু আর রুকাইয়া কখনোই এক জিনিস নয়।
নির্ধারিত টাকা দিয়ে রুকাইয়া করা হলে হা জায়েজ?