জরায়ু ইনফেকশন কেন হয়
বর্তমান সময়ে মহিলাদের জরায়ুর ইনফেকশনে আক্রান্তের হার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে কম বয়সী মহিলাদের বিশেষ করে যাদের বয়স ২০-৪০ বছর তাদের জরায়ু ইনফেকশন এর হার সবচেয়ে বেশি। ৮৫% ক্ষেত্রে সাধারণত স্বাভাবিকভাবে শুধু যৌনবাহিত কারণে এটি হতে পারে। ১৫% ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে যেমন কপারটি, ডিঅ্যান্ডসি, হিস্টারোসালফিঙ্গগ্রাফি, এন্ডোমেট্রিয়াল বায়োপসি নামক পরীক্ষার পর জীবাণু সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে।
দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে ২৫ বছরের মহিলাদের এবং এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে ৩০ বছরের মহিলাদের বা তার বেশি বয়সে মহিলাদের হয়ে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে পেলভিক ইনক্লেমেটরি (PID) ডিজিজ বলে। আজকে আপনাদের সাথে এই আর্টিকেলে শেয়ার করবো মহিলাদের জরায়ু ইনফেকশন কেন হয়।
জরায়ু ইনফেকশন হলে কি হয়
জরায়ুত ইনফেকশন হলে পেটের ভিতরে ইনফেকশন ছড়িয়ে গিয়ে ডিম্বনালী ও ডিম্বাশয়ে চাকা হাওয়া, পেরিটোনাইটিস ও সেফটিসেমিয়া নামক জটিলতা হতে পারে। একবার সংক্রমিত হলে বন্ধ্যত্ব হওয়ার আশংকা ১২%, দুইবার হলে ২৫% এবং তিনবারের বেশী হলে এই আশংকা ৫০%।
এছাড়া সবসময় তলপেটে বা পীঠে ব্যথা বা সহবাসে ব্যথা থেকেই যায়। এদের একটোপিক প্রেগনেন্সি (জরায়ু ছাড়া পেটের ভিতর অন্য জায়গায় বাচ্চা আসা) ৬ – ১০ গুণ বেশী।
কাদের জরায়ু ইনফেকশন ঝুঁকি বেশি
মাসিক হয় এমন অল্প বয়সী (Reproductive Age) – এর মহিলাদের যাদের একাধিক পুরুষ যৌনসঙ্গী আছে, যারা পিল বা কনডম ব্যবহার করেন না, আগে যাদের জরায়ু ইনফেকশন হয়েছে, যারা কপারটি ব্যবহার করেন এই ধরনের নারীদের জরায়ু ইনফেকশন ঝুঁকি বেশি থাকে।
তবে সচেতন থাকলে ও শুরু থেকেই ডাক্তারের পরামর্শ নিলে এই মরনঘাতী রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
আরো পড়ুন – জরায়ু ক্যান্সার কি? জরায়ু ক্যান্সার হলে করনীয়
নারীদের জরায়ু ইনফেকশন হওয়ার ১০ টি কারণ
বিভিন্ন কারণে নারীদের জরায়ু প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণগুলো প্রত্যেক নারীকেই জেনে রাখা উচিত এবং কেন জরায়ুতে ইনফেকশন হয় এই সম্পর্কেও। তাতে জরায়ু সংক্রান্ত অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত জটিল সমস্যা থেকে নিরাপদ থাকা সহজ হবে। নিম্নে প্রধান কারণ গুলো উল্লেখ করা হলো –
১. ঠান্ডা লাগা, ভিজা স্যাঁত স্যাঁতে স্থানে বসে থাকা, ঋতু বন্ধ হওয়া, অতিরিক্ত স্বামী সহবাস করা, কষ্টকর জরায়ুর উত্তেজনা ইত্যাদি কারণ হতে পারে।
২. জরায়ুতে নানা প্রকার জীবাণু দূষণ যেমন – মনিলিয়াল ইনফেকশন, ট্রাইকোমনা দেখে নেভার প্রদাহ হতে পারে।
৩. জরায়ুতে ক্ষত, টিউমার ইত্যাদির জন্য ইনফেকশন হতে পারে।
৪. ঋতুস্রাবের সময় নোংরা নেকড়া, কাপড় ইত্যাদির ব্যবহার থেকেই রোগ হতে পারে।
৫. B.coli রোগে অনেকদিন ভুগলে অথবা প্রস্রাব নালী নির্গত জীবাণু এই পথে প্রবেশ করে এই প্রদাহ হতে পারে।
৬. গনোরিয়া, সিফিলিস প্রভৃতি রোগ থেকে এই প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে।
৭. গর্ভপাতের পরে কোন কিছু Incomplete হলে অথবা Complete এই জাতীয় প্রদাহ হতে পারে অর্থাৎ আজকাল যেভাবে জোর করে গর্ভপাত করানো হয়ে থাকে এর ফলে এই রোগটি অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৮. Curate অপারেশন ঠিকভাবে করতে না পারলে জরায়ু প্রদাহ দেখা দিতে পারে, এছাড়া অন্যান্য অপারেশনের ক্ষেত্রেও এটি দেখা দিতে পারে।
৯. কিথিটার প্রয়োগের সময় তাতে জীবাণু থাকলে তা দ্বারাও প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে। আবার অনেক সময় প্রদাহ হয় কিন্তু তার সঠিক কারণ জানা যায় না।
১০. প্রস্রাবের পর ঠিকমতো যত্ন না নেয়ার জন্য জরায়ুর গাত্রে ফুল পড়ে যাওয়ার ফলে ঘা থাকে এবং ঐ ঘায়ের মধ্যে জীবাণু প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
জরায়ু ইনফেকশন উপসর্গ
নারীদের জরায়ু ইনফেকশন কেন হয় তা জানতে হলে প্রথমেই আমাদের এই রোগের উপসর্গগুলো ভালোভাবে জানতে হবে। জরায়ু ইনফেকশনের কিছু কমন উপসর্গ হলো
- তলপেটে ব্যথা
- জ্বর
- মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তস্রাব
- দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব
- পুঁজের মতো স্রাব
- সহবাসে ব্যথা
- মাসিক ছাড়া রক্তস্রাব
উপসর্গ দেখা দিলে ভীত না হয়ে দ্রুত ডাক্তারের দ্বারস্থ হতে হবে। শুরুতেই ডাক্তারের কাছে গেলে জটিল আকার ধারন করার আগেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
জরায়ু ইনফেকশন সংক্রমণ পদ্ধতি
যৌন সংক্রমণ মাধ্যমে পুরুষের শুক্রাণু ও ট্রিকোমোনাড (যা পুরুষের যৌনাঙ্গে থাকে) বাহিত হয়ে জীবাণুগুলো নারীর যৌনাঙ্গে প্রবেশ করে। পরে জীবাণুগুলো জরায়ু, নালী হয়ে ডিম্বাশয়ও আক্রমণ করে। দীর্ঘদিন সংক্রমণ চলতে থাকলে জরায়ু নালী ধ্বংস হয়ে বন্ধ্যত্বও হতে পারে।
রোগ নির্ণয়
জরায়ু মুখের রস, প্রস্রাবের রাস্তায় রস এবং বার্থোলিন গ্ল্যান্ড (মাসিকের রাস্তার মুখে এক ধরনের গ্রন্থি) – এর রস নিয়ে জীবাণু নির্ণয় ও কালচার করে, এছাড়া রক্ত পরীক্ষা, ল্যাপারোস্কোপি, সোনোগ্রাফি করে রোগ নির্ণয় সম্ভব।
সাধারণত সরকারি বেসরকারি যেকোনো ধরনের হসপিটালে বর্তমানে জরায়ু ইনফেকশন পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রয়েছে। সঠিক সময়ে পরীক্ষা না করালে পরবর্তীতে এই ইনফেকশন থেকে জরায়ু ক্যান্সার হতে পারে।
আরো পড়ুন – জরায়ু ক্যান্সার কি? জরায়ু ক্যান্সার হলে করনীয়
জরায়ু ইনফেকশনের ঔষধ
প্রাথমিক অবস্থায় এন্টিবায়োটিক এবং পেইন কিলার দিয়ে জরায়ু ইনফেকশনের চিকিৎসা করা হয়। এ ক্ষেত্রে ওষুধগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় খেতে হবে। জরায়ু সংক্রমণের প্রতিকারে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক।
- pulmocef 1500
- zomycin 250
- zybact 250 mg
- cefadur CA 250 mg
- zycin 250 mg
- altaxime 500 mg
- cef 250
যদি এসব অ্যান্টিবায়োটি সেবনের পরেও যদি কোন উন্নতি না দেখা যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে আপনি অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
জরায়ু ইনফেকশনের অপারেশন
জরায়ু ইনফেকশন হয়ে গেলে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী কিছু সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সার্জারি করা দরকার হতে পারে। যেমন –
ডিম্বনারী সংক্রিত হয়ে পুজের সৃষ্টি হলে এবং বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায়। এছাড়া যাদের বয়স বেশি তাদের সংক্রমণের তীব্রতা কমানোর জন্য এবং জরায়ু সার্জারি করে অপসারণ করা হয়।
উল্লেখ্য, আপনার যদি ব্যাক্টোরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস ধরা পড়ে তাহলে আপনি কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হবে যা গর্ভকালীন সময় নিরাপদ। তবে আপনাকে অবশ্যই এন্টিবায়োটিকের কোর্সগুলো শেষ করতে হবে যদি সংক্রমণের লক্ষণগুলো সেরে যায় অন্যথায় আবারো যেকোনো মুহূর্তে লক্ষণ গুলো দেখা দিতে পারে। ত্রিশ ভাগ মহিলাদের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস তিন মাসের মধ্যে আবার দেখা দেয়।
অ্যান্টিবায়োটিক এর কাজ হলো খারাপ ব্যাকটেরিয়া গুলোকে মেরে ফেলা কিন্তু একটি ভালো ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। পুনরায় লক্ষ্ণ প্রকাশ পেলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবেন। আপনার বা আপনার জীবনসঙ্গীর জরায়ু ইনফেকশন কেন হয় সেটি খুঁজে বের করুণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুণ।
জরায়ু ইনফেকশন এর হোমিও চিকিৎসা
হোমিওপ্যাথিতে ইনফেকশনে চিকিৎসা এন্টিবায়োটিকের এর চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। করলে কিছুদিন পরে পুনরায় ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু হোমিওপ্যাথির নির্দিষ্ট কোর্স সম্পূর্ণ করলে পরবর্তীতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম তাই আপনি এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত নিন।
আপনার জরায়ু ইনফেকশন চিকিৎসার জন্য ভালো হোমিও চিকিৎসক দেখাতে পারেন। চিকিৎসকের কাছে থেকে জরায়ু ইনফেকশন কেন হয় বিস্তারিত খুঁটি নাটি জেনে নিন।
জরায়ু ইনফেকশনের ঘরোয়া চিকিৎসা
প্রিয় পাঠক চিকিৎসাবিজ্ঞান বর্তমানে উন্নত তবে হ্যাঁ ডাক্তারি পরামর্শ পাশাপাশি আপনি এর জন্য ঘরোয়া কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। ভিডিওটি দেখে নিই ঘরোয়া উপায়ে কিভাবে রোগটির প্রতিকার করবেন:
খাবার – আপেল, দই, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি খেলে জরায়ু সমস্যা কম হয়। এসকল খাবার খাওয়ার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে। শরীর সুস্থ রাখতে বাইরের মসলাদার খাবার, ভাজাভুজি, জাঙ্ক ফুড খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
শারীরিক সম্পর্ক – শারীরিক সম্পর্কের সময় প্রোটেকশন ব্যবহার করা উচিত। প্রোটেকশন (মানে বুঝতে পারছেন তো) বিভিন্ন যৌনাঙ্গ রোগ প্রতিরোধ করা সহায়ক।
এছাড়া শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা পরবর্তী সময়ে আপনার বিশেষঙ্গ পানি দিয়ে পরিস্কার করুণ।
নিয়মিত প্যাড পরিবর্তন করুণ – পিরিয়ডের সময় দিনে অন্তত ৩ – ৪ বার পরিবর্তন করুণ কারণ পিরিয়ডের সময় ব্যাকটেরিয়া আক্রান্তের আশংকা বেশী থাকে। সারাটা দিন যদি একটা প্যান্ট পরে থাকলে ভিজে জায়গায় ব্যাকটেরিয়া তৈরি হতে পারে। তাই জরায়ু ভালো রাখার উপায় হিসাবে এই পদ্ধতি অনুসরণ করুণ।
ট্রিম বা সেভ করুণ – যোনীর চুল বড় হয়ে গেলে সেভ করে ফেলুন যৌনাঙ্গ পরিস্কার রাখতে সুবিধা হবে এবং সংক্রমের আশংকা কমে যাবে। কিন্তু, হ্যাঁ এখানে কোন হেয়ার রিমুভার ক্রিম ব্যবহার করা উচিত নয়। প্রিয় পাঠক দীর্ঘদিন ধরে যদি চুলকানি বা ব্যথা হয় এবং আঠার মতো চটপটে ডিসচার্জ অথবা সমস্যা দেখা দিলে আপনি আর দেরি না করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
মন্তব্য
প্রিয় পাঠক আমাদের জরায়ু ইনফেকশন কেন হয় এই আর্টিকেলটি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর পরামর্শের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। আপনাদের কোন মতামত থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাবেন। অতি দ্রুতই রিপ্লাই দেয়ার চেষ্টা করবো এবং জরায়ুর ইনফেকশনে আক্রান্ত যদি আপনার কোন পরিচিত থাকে তাহলে তাকে এই আর্টিকেলটি শেয়ার করে দিন।
আরো পড়ুন – জরায়ু ক্যান্সার কি? জরায়ু ক্যান্সার হলে করনীয়