বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা
বাচ্চা যখন অসুস্থ হয় তখন সবথেকে বেশি টেনশন এ থাকেন একজন মা। পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনার বর্তমানে নবজাতক বাচ্চাদের অসুস্থ হওয়ার প্রবনতা অনেক বেশি দেখা যায়। বাচ্চার বমির ভাব দেখা দিলে শুরুতেই ডাক্তারের কাছে না নিয়ে ঘরোয়া চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা বলতে আমরা বঝিু ,কোন রকম ডাক্তারি চিকিৎসা ছাড়া হাতের কাছে পাওয়া জিনিস থেকে বা ঘরে থাকা জিনিস দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা সেরে ফেলা।
আজকে আমরা বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা, বাচ্চাদের বমির সিরাপের নাম নিয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
বাচ্চাদের বমি কেন হয়?
বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে প্রথমে আমাদের জানতে হবে বাচ্চাদের বমি কেন হয়। কেননা অসুস্থতার প্রধান কারণ জানতে না পারলে বারবার এই রোগটি হতে পারে। নিজে আমরা বাচ্চাদের বমি হওয়ার কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ ও এর থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে আলোচনা করছি।
বদহজম হওয়ার কারণে
বদহজম হলো একটি বিরক্তিকর সমস্যা। অনেক সময় দেখা যায় পেটে কোন সমস্যা না থেকলেও পেটের মধ্যে কেমন যেন
অস্বস্তি কর একটা যন্ত্রণা সৃষ্টি হয় এবং তৎক্ষণাৎ পাতলা পায়খানা শুরু হয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ফুড পয়জনিং। শুশুকে একসাথে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ানো এবং ঝাল জাতীয় বা অতিরিক্ত মশলা জাতীয় খাবার খাওয়ানোর কারনে ফুড পয়জনিং হতে পারে।
কৃমির সংক্রমণ
পেটে যখন কৃমির সংক্রমণ শুরু হয় তখন পেট ব্যথা সহ পেট ফুলা শুরু হয়ে যায়। এই রকম কন্ডিশনে শিশুর বমি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিশুকে ময়লাযুক্ত স্থানে রাখা বা অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার খাওয়ালে কৃমির সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও লম্বা সময় কৃমির ট্যাবলেট না খাওয়ালেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মোশন সিকনেস বা গতি অসুস্থতা
এটি সাধারনত বাসে বা গাড়িতে বেশিক্ষন চড়লে বাচ্চাদের বমির সমস্যা হয়ে থাকে। এটি কোন রোগ নয়। অনেক বয়ষ্ক মানুষের ও বাসে বা গাড়িতে চড়লে মোশন সিকনেস হয়ে থাকে। জয়ট্রিপ কিডস নামের ট্যাবলেট গাড়িতে উঠার ১০ মিনিট আগে খেয়ে নিলে সাধারনত আর বমি আসে না।
ফুড পয়জনিং বা খাবার বিষক্রিয়া
অতিরিক্ত ঝাল বা অতিরিক্ত মশলা জাতীয় খাবার খেলে বাচ্চাদের অনেক সময় ফুড পয়জনিং বা খাবার বিষক্রিয়া হয়ে থাকে। এছাড়া স্কুলে গিয়ে বাচ্চারা যদি বাইরের খাবার গ্রহন করে সেক্ষেত্রেও অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহনের ফলে ফুড পজনিং হতে পারে। ফুড পয়জনিং হলে সাথে সাথে বমি, মাথা ব্যথা ও পেট ব্যথা করবে। কিছুক্ষেত্রে পেট ফুলে যেতে পারে।
গ্যাসের সমস্যা
গ্যাসের কারনে বমি হওয়া খুব ই কমন একটা ব্যাপার। বিশেষ করে যেসব বাচ্চারা মায়ের বুকের দুধ পান করে সেক্ষেত্রে মায়ের খাবার গ্রহনের উপর নির্ভর করে বাচ্চার গ্যাসের সমস্যা হতে পারে। আর যেসব বাচ্চারা মায়ের দুধ পান করে না অর্থাৎ বড় তাদের ও বিভিন্ন কারনে গ্যাসের সমস্যা হতে পারে। গ্যাসের সমস্যা হলে প্রথম লক্ষন হচ্ছে বাচ্চা খাবার খেতে চাইবে না আর দ্বিতীয় লক্ষন হচ্ছে বাচ্চা বমি করবে।
খাদ্যনালীতে ইনফেকশন
কিছু এক্সট্রিম কেইসে বাচ্চাদের খাদ্যনালীতে ইনফেকশন হয়ে গেলে ঘন ঘন বমি হয়। বিশেষ করে লম্বা সময় খাবার গ্রহনের পর বমি হলে ধরে নিতে হবে খাদ্যনালীতে ইনফেকশন হয়েছে। সেক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা গুলো কি?
এই পর্যায়ে আমরা বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করবো। বাচ্চার বমি শুরু হলে শুরুতেই ডাক্তারের কাছে না গিয়ে প্রাথমিকভাবে ঘরোয়া ট্রিটমেন্ট দিতে পারেন।
অধিক পরিমানে তরল খাবার দিন
বমি করলে আপনার শিশুর অবস্থা আস্তে আস্তে খুব খারাপ হতে পারে। হারিয়ে যাওয়া শক্তিকে আবার ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই শিশুকে তরল খাবার দিতে হবে। চেষ্টা করতে হবে কিছু সময় পর পর পুষ্টিকর তরল খাবার দিতে এতে করে বাচ্চা দূর্বল হয়ে পড়বে না। বাচ্চার বয়স কম হলে ঘন ঘন মায়ের বুকের দুধ দেয়ার চেষ্টা করতে হবে।
কঠিন খাবার (খিচুটি, শাকু, ডিম) দেয়ার আগে অবশ্যই বাচ্চার কন্ডিশন বুঝে নিতে হবে। কঠিন খাবার দেয়ার আগে দেখে নিন যে হজম প্রক্রিয়া ঠিক আছে কিনা। এরকম অবস্থায় তাকে ভেজিটেবিল সুপ অথবা সাধারণ ঝোল জাতীয় খাবার দিতে পারেন।
আরো পড়ুন – শিশুর পাতলা পায়খানার ঔষধ – বাচ্চার ডায়রিয়া হলে করনীয়
বমি শুরু হওয়ার প্রথম ২৪ ঘন্টা শুধু তরল খাবার দিতে হবে। কোন শক্ত খাবার না দেয়াই ভালো।
আদার রস এবং মধু মিক্স করে খাওয়ান
বমি ভাব দূর করার জন্য আরেকটি কার্যকরী উপায় হল আদার রসে র সাথে মধু মিশিয়ে খাওয়ানো। তবে সে ক্ষেত্রে মাথায়
রাখতে হবে শিশুর বয়স অনপুাতে এই রস খাওয়ানো যেতে পারে । বয়স ও বমির পরমানের উপর নির্ভর করে কিছু সময় পর পর অল্প অল্প করে এই রস খাওয়াতে পারেন।
০ – ২ বছরের শিশুদের এই ধরনের রস খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। তবে শিশু যেহেতু মায়ের বুকের দধু খায় তাই যদি মা এই রস টা খেয়ে নেয় তাহলে শিশুর অনেক কাজে দেবে।
পুদিনা পাতার রস খাওয়ানোর মাধ্যমে
পুদিনা পাতার রস অনেক উপকারী একটা ঔষধ বলা চলে। এটি বমিভাব দূর করে সাথে শারীরিক অনেক রোগ থেকে এটি
মুক্তি দেয়। আপনি চাইলে পুদিনা পাতার রসের সাথে লেবু ও মধু মিশিয়ে খাইয়ে দিতে পারেন। আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে
এবং শিশুর বমি বমি ভাব আস্তে আস্তে কেটে যাবে।
ভাতের মাড় বা ফ্যান খাওয়া যেতে পারে
বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা য় ভাতের মাড় বা ফ্যান ব্যবহার করতে পারেন। প্রথমে আপনি এক কাপ সাদা চাউল বা আতপ চাউল নিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে দুই কাপ অথবা 3 কাপ পানিতে জাল করুন। চাল পুরাপুরি সিদ্ধ হওয়ার পর ভাতের মাড় বা ফ্যান কোন একটা পরিস্কার পাত্রে ঢেলে নিন। পরে এই মার আপনি আপনার শিশুকে খাওয়াতে পারেন।
এলাচির দানা চিবিয়ে খাওয়া
বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসায় এলাচির দানা অনেক কার্যকরী একটি ওষুধ বলা চলে। এলাচির দানা যদি চিবিয়ে
খাওয়া যেতে পারে তাহলে খুব তাড়াতাড়ি বমি ভাব দূর হয়ে যায়। বমি ছাড়াও এলাচি বাচ্চাদের নানা রকম রোগ প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে।
লবঙ্গ পানিতে সিদ্ধ করে খাওয়ার মাধ্যমে
পানিতে লবঙ্গ সিদ্ধ করে খাওয়ার মাধ্যমেও কিন্তু বমি ভাব দূর করা যায়। সে ক্ষেত্রে প্রথমে আপনাকে পাঁচ থেকে ছয়টা
লবঙ্গ নিয়ে এক কাপ পানিতে ভালোভাবে ফুটিয়ে নিতে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত পানি হালকা হলুদাভাব না আসে ততক্ষণ
পর্যন্ত জ্বাল করে নিতে হবে। জাল করার পর পানি ঠান্ডা করে আপনি আপনার শিশুকে খাওয়াতে পারন।
মৌরি খাওয়ার মাধ্যমে
শিশুর বমি ভাব থেকে দূর করার জন্য সবথেকে কার্যকরী একটি উপাদান হচ্ছে মৌরি। মৌরির দ্বারা খুব উপকারী
একটি খাবার। প্রথমে আপনাকে এক চা চামচ পরিমাণ মৌরি 2 কাপ পানিতে ভালোভাবে ফু টিয়ে নিতে হবে। পানি
ভালোভাবে ফু টানোর পর ঠান্ডা করে আপনি আপনার শিশুকে দিতে পারেন। শিশুদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসায় একটি
অন্যতম চিকিৎসা বলা যেতে পারে।
অ্যাপেল সিডার ভিনিগার খাওয়ার মাধ্যমে
এন্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য অ্যাপেল সিডার ভিনিগার বমি ভাব দূর করার জন্য বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসায় একটি কার্যকারী ফর্মুলা। এটি ব্যবহার করে আপনি সহজে আপনার শিশুর বমি ভাব থেকে মুক্তি দিতে পারবেন। এক গ্লাস পানিতে এক চা চামচ অ্যাপেল সিডার ভিনেগার নিয়ে সাথে এক চা চামচ মধু মিশিয়ে আপনার শিশুকে দিতে পারেন। অ্যাপেল সিডার ভিনেগার শুধু বমি ভাব দূর করবে না এটি শরীরের আরো অনেক উপকার করে।
এগুলো হল খুব সহজ উপায়ে বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা। বাড়িতে এগুলো চেষ্টা করতে পারেন তবে যদি দেখতে পান যে কোনোভাবে ও বাচ্চার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না তখন অবশ্যই একজন ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
বাচ্চাদের বারবার বমি হলে করণীয়
উপরে আমরা বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি তারপরও করলে ২- ৩ দ্বীনের পথে বাচ্চার বমি সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার কথা। তবে কোনো কারণে তিন দিন পার হয়ে গেলে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
একই সাথে যদি বাচ্চার বারবার বমি হয় সে ক্ষেত্রে ঘরোয়া চিকিৎসা করার পাশাপাশি একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন। বেশকিছু কারনেই বাচ্চাদের বারবার বমি হতে পারে। নিচে আমরা কয়েকটি বলে করার চেষ্টা করছি
- পেটে কৃমির সমস্যা থাকলে
- গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হলে
- অতিরিক্ত তেল জাতীয় মসলাজাতীয় খাবার খেলে
বাচ্চাদের বমির সিরাপের নাম
সাধারণত বাচ্চাদের বমির জন্য এটা বেশ কিছু সীরাপ সাজেশন দিয়ে থাকেন। আমরা কোনভাবেই কোন ঔষধ সাজেস্ট করতে পারে না কেননা বাজে কন্ডিশন এর উপর নির্ভর করে ঔষধের ধরন অবশ্যই ভিন্ন হবে। তাই প্রথমে বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা অনুসরণ করুন এবং প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিন।
তবে বমির জন্য সাধারণত যে সিরাপ গুলো ডাক্তাররা লিখে থাকেন এমন কিছু সিরাপের নাম নিচে উল্লেখ করা হলো
- Emistat
- Don – A
- Zofra
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
পানি শুন্যতা দেখা দিলে – বমি করতে করতে আপনার শিশুর মধ্যে পানি শুন্যতা দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কিভাবে বুঝবেন পানি শুন্যতা দেখা দিয়েছে কি না? সাধারনত শিশুরা (যেকোন বয়সের শিশু) ৬ ঘন্টার বেশি পশ্রাব না করলে বুঝে নিতে হবে পানি শুন্যতা দেখা দিয়েছে।
প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর পর বমি করলে – ১ মাসের কম বয়সী শিশুরা প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর পর যদি বমি করে দেয় সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ৩ দিনের বেশি এমন হলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
বমির পাশাপাশি কাশি থাকলে ও কফের সাথে রক্ত গেলে – বাচ্চার যদি বমির পাশাপাশি কাশিও থাকে সেক্ষেত্রে এটি ভয়ংকর রূপ ধারন করতে পারে। বিশেষ করে কফ বা থুথুর সাথে রক্ত গেলে বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা পাশাপাশি দ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে।
বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা
আমরা জানলাম বাচ্চাদের বমির ঘরোয়া চিকিৎসা, বাচ্চাদের বমির সিরাপের নাম কি। তবে কোনো রকম কোনো সর্দির সিরাপ খাওয়ানোর আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কেননা বাচ্চার শরীরের কন্ডিশন এর ওপরে নির্ভর করে ঔষধ এর ধরন ও ডোজ সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে।
আরো পড়ুন – বাচ্চাদের কৃমি তাড়ানোর ঘরোয়া উপায় – ছোট বাচ্চাদের কৃমির ঔষধ