শিশুর ওজন কম হলে করনীয়
বয়স এবং উচ্চতার মিল রেখেই বাচ্চাদের ওজন যথাযথ বৃদ্ধি পাওয়া জরুরী। ওজন কম থাকলে বাচ্চাদের বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। বাচ্চা বেশি ঘন ঘন অসুখে ভুগতে পারে। আজকে আমরা শিশুর ওজন কম হলে করনীয় বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আরো পড়ুন – নবজাতক শিশুর প্রস্রাব না হলে করনীয়
শিশুর ওজন কম হওয়ার কারণ
বিভিন্ন কারণে শিশুর ওজন কম হয়ে থাকে। তবে শিশুদের ওজন কম হওয়ার পেছনে মায়েদের ভূমিকা এবং অসাবধানতা বেশি লক্ষণীয়। তবে অনেকগুলো রোগের ক্ষেত্রেও শিশুর ওজন কমে যেতে পারে। শিশুর ওজন কম হলে করনীয় কি তা জানার পূর্বে কোন কারণে শিশুর ওজন কম হয়ে থাকে তা জানা প্রয়োজন।
- নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে অর্থাৎ গর্ভধারণ এর ৩৭ সপ্তাহের আগে বাচ্চার জন্ম লাভ করা
- মায়ের অপুষ্টি জনিত সমস্যা থাকলে
- বাচ্চার রক্তস্বল্পতা
- একাধিক গর্ভধারণ করলে
- ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা
- উচ্চ রক্তচাপ
- ফুসফুসের গঠন ঠিকমত না হওয়া
- বিলিরুবিনের মাত্রা বেশি থাকায় জন্ডিস দেখা দেয়া
- অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা
- স্বাস্থ্যকর খাবার মেনু ফলো না করা
- বাচ্চাকে পরিমাণ মতো খাবার না খাওয়ানো
- ঘন ঘন অসুস্থ হওয়া কোন অসুখে দীর্ঘদিন ভুগতে থাকা
- বাচ্চার অরুচি থাকা
কোন ধরনের রোগের ফলে ওজন বাড়ে না
শরীরের বিভিন্ন রোগের ফলেও বাচ্চাদের ওজন বৃদ্ধি হয় না। শিশুর ওজন কম হলে করণীয় কি তা জানার পূর্বে ওজন বৃদ্ধির জটিলতা গুলা জানা প্রয়োজন।
- হৃদপিণ্ড জনিত সমস্যা
- শারীরিক বৃদ্ধির অস্থিতিশীলতা
- অপুষ্টি
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়া
- দুর্বল পেশী কাঠামো শক্তির অভাব
- বিভিন্ন সংক্রমণ রোগ
- ঘন ঘন অসুস্থ হওয়া
শিশুর ওজন বাড়ানোর ঘরোয়া উপায়
শিশুর ওজন বাড়ানো তুলনামূলক কঠিন কাজ। কারণ যেসব বাচ্চাদের ওজন কম থাকে সাধারণত তাদের খিদে কম থাকে বা খাওয়ানো খুবই কঠিন হয়ে যায়। নানা রকম সমস্যার ফলে বাচ্চাদের ওজন বাড়ানো যায় না। বাচ্চাদের ওজন বাড়ানোর জন্যপ্রতিদিনই খাদ্য তালিকায় কোন কোন পদ্ধতি ফলো করা উচিত তা জানা প্রয়োজন –
শিশুর শরীরের যত্ন- সাধারণত বাচ্চাদের ঠিকভাবে যত্ন নিলেও মাঝে মাঝে ওজন কমে যেতে পারে। তবে ওজন কম থাকা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন নিতে হয়। কম ওজনের বাচ্চারা হাইপোথারমিয়া রোগে আক্রান্ত হয় খুব বেশি। সেজন্য শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে হবে।
শিশুকেপরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা- বাচ্চাকে সব সময় ধরার পূর্বে নিজের হাত অবশ্যই সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালোমতো পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং শিশুর জামা কাপড় ও খেলনা সব সময় পরিষ্কার নিয়ে রাখতে হবে।
শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করা- কম ওজনের শিশুর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য অবশ্যই প্রয়োজন। ক্রোমোজোমের শিশুর যার সাথে বৃদ্ধির জন্য মায়ের দুধের কোন বিকল্প নেই। তবে দু বছরের বেশি হলে তাকে মাল্টিভিটামিন ও মিনারেলেরও প্রয়োজন হতে পারে যা ডাক্তারি পরামর্শ অনুযায়ী শিশুকে দেয়া যেতে পারে।
পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো- বাচ্চাদের এমন অনেকগুলো খাবার আছে যা খুব সহজেই নিয়মিত খাওয়ালে বাচ্চাদের ওজন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় সেসব পুষ্টিকর খাবার বাচ্চাদের বেশি বেশি করে খাওয়াতে হবে। যেমন- সবুজ শাকসবজি ফলমূল এবং প্রচুর পরিমাণে পানি।
ধূমপান এবং অ্যালকোহল মুক্ত রাখা- মনে রাখতে হবে সিগারেটের ধোঁয়া এবং অ্যালকোহলের তীব্র গন্ধ বাচ্চাদের জন্য খুবই বিপদজনক। কম ওজনের বাচ্চাদের জন্য মৃত্যুর কারনও হতে পারে। শিশুর সামনে ধূমপান মধ্যপান বা ড্রাগ জাতীয় কিছু গ্রহণ করা একদমই উচিত নয়।
খাবারের সময়কে আনন্দময় করা- শিশুকে সবসময় খাবার সময় জোর করা যাবে না। খাবার সময়কে আনন্দময় করে তুলতে হবে। শিশুকে খাবার খাওয়ানোর সময় কোন রকম তাড়াহুড়া করা যাবে না। পরিবারের সবাই একসাথে খাওয়ার সময় শিশুকে নিয়ে খাবার খেতে বসতে হবে এতে করে সে খাওয়ার জন্য অনুপ্রেরিত হবে।
জাঙ্ক ফুড না খাওয়ানো- শিশুকে আর যাই হোক কখনো জাঙ্ক ফুট বা ফাস্টফুডের প্রতি আসক্ত হতে দেওয়া যাবে না। সেদিকে বিশেষ করে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুকে সবসময় স্বাস্থ্যকর খাবার ব্যাপারে আগ্রহী করতে হবে না হলে পরবর্তীতে শিশু কোন স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে চাবেনা।
খাবারে ভিন্নতা- শিশুকে সবসময় একইরকম খাবার দেওয়া যাবে না এতে করে সে খাবারের ব্যাপারে অনিহা প্রকাশ করবে। আবার রান্না ও বিভিন্ন রকমের রেসিপির ব্যাপারে এবং খাওয়ার পরিবেশনের সময় শিশুর পছন্দমত খাবার পরিবেশন করতে হবে। আর শিশুকে খাবার খেতে উৎসাহিত করলে শিশুর ওজন সঠিকভাবে বাড়ে।
খাবারের মাঝে অতিরিক্ত পানি পান করা– খাবারের মাঝে মাঝে অতিরিক্ত পানি পান করলে শিশুর পেট ভরে যায়। তাই শিশুকে খাবারের মাঝে পানি পান করতে দেওয়া যাবে না। এতে করে শিশু কম পরিমাণ খাবার গ্রহণ করবে এবং ওজন কমে যাবে।
কোন কোন খাবার শিশুদের ওজন বাড়ায়
এমন অনেকগুলো খাবার রয়েছে যা খেলে সহজেই বাচ্চাদের ওজন বেড়ে যায়। নিজে এমন কয়েকটি খাবারের তালিকা দেওয়া হলো-
আলু- খেতে সাধারণত বাচ্চারা খুবই পছন্দ করে। স্বাস্থ্যকর ভাবে ওজন বাড়ানোর জন্য আলোর কোন জুড়ি নেই। আলুর মধ্যে রয়েছে প্রচুর ক্যালরি অ্যামাইনো এসিড এবং ফাইবার। যেকোনো বয়সের বাচ্চাকে আলু রোজ খাওয়ানো যেতে পারে।
ডিম- ডিম হলো সম্পূর্ণ একটি খাবারের নাম। ডিমের মধ্যে সব ধরনের প্রোটিন ও ভিটামিন আছে। বাচ্চাদের স্বাস্থ্যকর ওজন ধরে রাখার জন্য প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়ানোর প্রয়োজন। বাচ্চার বয়স অনুসারে দুটি করে ডিম দেওয়া যেতে পারে এক্ষেত্রে প্রতি ছয় কেজি বাচ্চাদের একটি করে এবং ১২ কেজির জন্য দুটি করে ডিম দেওয়া যায়।
ডেইরি প্রোডাক্ট- দুধ মাখন চিজ বাচ্চাকে অবশ্যই খাওয়াতে হবে। বাড়ন্ত বাচ্চাদের জন্য এই দুধের তৈরি বিভিন্ন জিনিস খুবই জরুরী এর মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকায় সন্তানের হাড় শক্ত হবে এবং সঠিকভাবে বৃদ্ধি হবে। প্রতিদিন দুধ অথবা দুগ্ধ জাতীয়ব্য খেলে তা ওজন বৃদ্ধিতে সহায়ক।
ড্রাই ফ্রুটস– শিশুর ওজন কম হলে করণীয় কি তা সম্পর্কে অনেকেই চিন্তাইয় থাকেন। বাচ্চার ওজন বাড়ানোর জন্য ড্রাই ফুড খুবই উপকারী। নানা ধরনের বাদাম ও বীজ সন্তানকে রোজ খাওয়ানো যেতে পারে। এর মধ্যে প্রচুর মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট থাকে যা ওজন বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
পিনাট বাটার- পিনাট বাটার যেমন সুস্বাদু তেমনি স্বাস্থ্যকর। এটি ভালো ক্যালরিতে ভরপুর খেতেও ভালো হওয়ায় পিনাট বাটার বাচ্চারা খুবই পছন্দ করে। বিভিন্ন জিনিসের সাথে মিশিয়ে পিনাট বাটার বাচ্চাকে প্রতিদিন খাওয়ালে খুব সহজে বাচ্চার ওজন বৃদ্ধি পাবে।
মাংস- বাচ্চাকে প্রতিদিন খাওয়ার তালিকায় যে কোন এক বেলা মুরগি অথবা রেডমীট টাইপের কোন যেকোন মাংস খাওয়ানো যেতে পারে। এর মধ্যে থাকে প্রচুর প্রোটিন যা বাচ্চাদের মাসেল তৈরি করতে সহায়তা করে। বাচ্চার অন্যতম ওজন বাড়ানোর অন্যতম উপায় হলো তাকে মুরগির বিভিন্ন রেসিপি করে খাওয়ানো।
কলা- কলায় প্রচুর এনার্জি পাওয়া যায়। ওজন বাড়ানোর জন্য কলা উপকারী। সাধারণভাবে একটি কলা ১০৫ ক্যালোরি থাকে ফল ছাড়াও মিল্কশেক বা ডেজার্ট হিসাবেও কলা বাচ্চাদেরকে দেওয়া যেতে পারে।
মাখন- স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে অন্যতম উৎস এটি।বড়দের মাখন খাওয়ায় কিছুটা সাবধান থাকতে হলেও শিশুদের ক্ষেত্রে এই নিয়মটি প্রযোজ্য নয়। ওজন বৃদ্ধির জন্য শিশুদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মাখন রাখতে হবে। মাখন বিভিন্ন জিনিসের সাথে দেওয়া যায় যেমন রুটি বা পাউরুটি। যা শিশুর ওজন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
এভকাডো- ওজন বৃদ্ধির জন্যই ফলটি বেশ কার্যকর। এতে ফ্যাট ক্যালোরি সবকিছু একসাথে পাওয়া যায় এর পুষ্টি উপাদান ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। দ্রুত ফল পেতে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এভোকাডো রাখা উচিত।
শিশুদের ওজনের তালিকা
শিশুর সঠিকভাবে বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা এ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত থাকে। শিশুটির সঠিক ভাবে বেড়ে উঠছে কিনা তা জানতে শিশু ওজন উচ্চতা গ্রোথ চার্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। ছেলে এবং মেয়ের শিশুর জন্য আলাদা চার্ট আছে যা দিয়ে খুব সহজেই শিশুর বৃদ্ধি মাপা যায়।
শিশুর ওজন বৃদ্ধির হিসাব – শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর প্রথম সপ্তাহে ওজন কিছুটা কম থাকে এবং দুই থেকে তিন সপ্তাহে ওজন একই থাকে। এরপর ধীরে ধীরে ওজন বাড়তে থাকে। প্রথম তিন মাসের প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম করে ওজন বাড়তে পারে। পরবর্তী মাসগুলোতে আরেকটু কম হারে ওজন বাড়তে থাকে।
তিন থেকে বারো মাস বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৮০ গ্রাম ওজন বাড়ে। ৬ মাস বয়সে শিশুর ওজন জন্মের সময়ের ওজনের দ্বিগুণ হয়। ১ বছর বয়েসে জন্মের ৩ গুণ, ২ বছর বয়সে ওজন চার গুণ ও ৩ বছর বয়সে ৫ গুন ওজন হয়।
জন্মের সময় শিশুর ওজন কম হলে করণীয়
সাধারণত জন্মের সময় প্রত্যেক শিশুর সর্বনিম্ন কেজি হতে হয় আড়াই কেজি। আন্ডার ওয়েটের শিশু জন্মগ্রহণ করলে শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি খুব বেশি থাকে। তাই শিশু ওজন কম হলে অবশ্যই শিশুর ভালোভাবে যত্ন নিতে হয়।
হাসপাতালে যত্ন – শিশুর ওজন খুব কম হলে জন্মের পর হাসপাতালে ভর্তি রেখে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে রাখতে হবে। সঠিক পুষ্টির জন্য মায়ের দুধের পাশাপাশি নাকে নল দিয়ে খাবার দিতে হতে পারে। শিশুর তাপমাত্রা কমে গেলে তাকে ইনকিউবেটরের রাখতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ শিশুর শ্বাসকষ্ট হয় অবস্থা বেশি খারাপ হলে এনআইসিইউ তে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হতে পারে।
বাসায় নিয়ে আসার পর যত্ন – হাসপাতালে যখন বাচ্চা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে এবং অন্যান্য শিশুর মত মায়ের বুকের দুধ খেতে শিখে এবং শিশুর ওজন বাড়তে থাকলে তখন হাসপাতাল থেকে বাচ্চাকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। এ সময় আলো বাতাস চলাচল করে এমন জায়গায় শিশুকে রাখতে হবে। ঘরের তাপমাত্রা যাতে স্বাভাবিক থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাচ্চা সঠিকভাবে খেতে পারছে কিনা সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন
শিশুর ওজন কম হলে সবচেয়ে বেশি ভালো হয় একজন পুষ্টিবিদের সাথে আলোচনা করলে। কেননা শিশুর ওজন কম হলে করণীয় বিষয় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। কেননা এগুলা আরো বিভিন্ন ধরনের রোগের লক্ষণ হতে পারে। শিশুর ওজন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলে অবশ্যই তাকে ডাক্তারের নিকট নিয়ে যেতে হবে।
মন্তব্য
আজকে আমরা শিশুর ওজন কম হলে করনীয় বিষয়গুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আশা করছি মায়েদের জন্য জন্য এটি অনেক কাজে আসবে। এই আর্টিকেল সম্পর্কে আপনাদের কোন মন্তব্য বা মতামত থাকলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। আমরা অতি দ্রুতই রিপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ
আরো পড়ুন –
- নবজাতক শিশুর প্রস্রাব না হলে করনীয়
- ৩ মাসের শিশুর সর্দি হলে করণীয়
- শিশুর ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার