কোয়েল পাখির বাচ্চা পালন
কোয়েল পাখির বাচ্চা পালন বর্তমানে একটি জনপ্রিয় ও লাভজনক ব্যবসা। অনেকে শখের বসেও কোয়েল পাখির বাচ্চা পালন করে থাকেন। শখের পাশাপাশি কোয়েল পাখির বাচ্চা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ও পালন করা যায়।
তবে আজকে আমরা খাঁচায় কোয়েল পাখির বাচ্চা পালন করার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য শেয়ার করব। আশা করছি আপনাদের ভালো লাগবে।
আরো পড়ুন – কোন জাতের কবুতর বেশি বাচ্চা দেয় বিস্তারিত জানুন
কোয়েল পাখির বৈশিষ্ট্য
অন্যান্য পাখি বা হাঁস-মুরগির তুলনায় কোয়েল পাখির বাচ্চা পালন অনেক লাভজনক। কেননা কোয়েল পাখির বৈশিষ্ট্য অন্যান্য পাখির থেকে বেশি।
- কোয়েলের শারীরিক বৃদ্ধির হার বেশি
- ৬ থেকে ৭ সপ্তাহের ভিতরে ডিম পাড়ে
- বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ ডিম কোয়েল পাখি পাড়ে
- ১৭ থেকে ২০ দিনের মধ্যে কোয়েল পাখি ডিম ফুটে
- একটি মুরগির জায়গায় আটটি কোয়েল পাখি পালন করা যায়
- কোয়েল পাখির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি
- ডিমের উর্বরতার হার ৮০ থেকে ৯০ ভাগ
- বিশেষ কোনো খাবার কোয়েলের জন্য সংগ্রহ করতে হয় না
- বাংলাদেশের আবহাওয়া কোয়েল পাখি পালার জন্য উপযোগী
খাঁচায় কোয়েল পাখি বাচ্চা পালন করার নিয়ম
কোয়েল পাখি সাধারণত দুইভাবে চাষ করা যায়।
- খাচায়
- ফ্লোর বা মেঝেতে
মেঝে পদ্ধতিতে বা ফ্লোর পদ্ধতিতে কোয়েল পাখি চাষ করার চাইতে খাঁচায় কোয়েল পাখি চাষ করা অনেক সহজ ও সুবিধাজনক। এতে অল্প জায়গায় অনেক কোয়েল পাখি চাষ করা যায়। খাঁচায় কোয়েল পাখি বাচ্চা পালন করতে
- লোহা বা জিআই জি তার দিয়ে কোয়েলের জন্য বিশেষভাবে খাঁচা তৈরি করতে হয়
- খাঁচার সামনে সামনের দিকে হালকা ভালো করতে হয় যাতে ডিম পারলে এক সাইডে চলে যায়
- খাঁচার একপাশে খাবার পাত্র এবং পানির পাত্র লাগানো থাকে
- আমাদের দেশে যে কোয়েল পাখির খাঁচা পাওয়া যায় তার পরিমাপ দৈর্ঘ্য ৬ ফুট, প্রস্থ আড়াই ফুট
- খাঁচায় তাকে সংখ্যা পাঁচটি
- প্রতি তাকের উচ্চতা ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি হয়
- প্রতিটি তাকে পাখি রাখা যায় একশোটি
- একটি খাঁচার মত ৫০০ টি পাখি রাখা যায়
- ৫০০ কোয়েল পাখির খাঁচা তৈরির খরচ ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা
কোন জাতের কোয়েল পাখি ভালো
বর্তমানে প্রায় 18 টি জাতের কোয়েল পাখি বাজারে পাওয়া যায়। যার প্রত্যেকটি জাতি ব্যবসার জন্য লাভজনক। এর মধ্যে কিছু কিছু কোয়েল ডিম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এবং কিছু কিছু কোয়েল মাংস উৎপাদনের জন্য বিখ্যআত। ব্রয়লার এবং লেয়ারের কিছু ভাল জাতের কোয়েল পাখির নাম হলো-
লেয়ার বা ডিম উৎপাদন কোয়েলের জাত- বাজারে অনেক লেয়ার পার্টি উৎপাদন কারি কোয়েল পাখির জাত পাওয়া যায়। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জাতের কোয়েল হলো-
- টুক্সিডো
- ফারাও
- ইংরেজি হোয়াইট
- ব্রিটিশ রাঞ্চ
- মাঞ্চুরিয়ান গোল্ডেন
কোয়েল পাখির খাঁচা বা বাসা বানানোর নিয়ম
- খাঁচা পদ্ধতিতে কোয়েল পালন, লিটার পদ্ধতির তুলনায় বেশি উপযুক্ত। খাঁচা পদ্ধতিতে, ব্যবস্থাপনা সহজ এবং রোগ বা অন্যান্য সমস্যা কম।
- ১২০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৬০ সেন্টিমিটার প্রস্থ এবং ২৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা পরিমাপ একটি খাঁচার মধ্যে ৫০ টি কোয়েল পালন করা যায়।
- একটি সঠিক বায়ুচলাচল সিস্টেম তৈরি করতে হবে যাতে কোয়েলের ঘরে যথেষ্ট আলো এবং বাতাস চলাচল করে।
- ইদুর ও বিড়াল হতে বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন
- প্লাস্টিকের খাঁচা কোয়েল পালনের জন্য সবচেয়ে সুবিধা জনক ও কম খরচ হয়।
- প্রাপ্তবয়স্ক কোয়েলের জন্য নেটের ছিদ্রের পরিমাপ ৫ মিলিমিটার গুণ ৫ মিলিমিটার হবে।
- ঘর অবশ্যই বন্য প্রাণীদের নাগালের বাইরে থাকতে হবে। এছাড়াও সব ধরনের শিকারী প্রাণীদের নাগালের বাইরে থাকতে কোয়েলের খাঁচা তৈরির জন্য তারের নেট ব্যবহার করতে হবে
খাঁচায় কোয়েল পাখি পালনের সুবিধা
খাঁচায় কোয়েল পাখি পালন করার অনেক সুবিধা রয়েছে। কোয়েল পাখি আকারে ছোট হওয়ায় এটিকে মেঝেতেও পালন করা সম্ভব। তবে খাঁচা পালন করার সুবিধা গুলো সম্পর্কে ধারণা থাকলে কোয়েল পাখি পালন আরও সহজ হয়।
- ডিম গড়িয়ে এসে ট্রেতে জমা হয়
- ফলে ডিম সংগ্রহ করতে সহজ হয়
- সহজে খাবার এবং পানি দেওয়া যায়
- ডিম ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে
- পাখির পায়খানা খাঁচার নিচে ট্রেতে জমা হয়, ফলে বারবার খাঁচা পরিষ্কার করার ঝামেলা থাকে না।
- একটি খাচায় পাঁচটি তাক করে অনেক পাখি পালন করা যায়
- ফ্লোরের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি পাখি খাচায় পালন করা সম্ভব
- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা সহজ হয় বলে পাখির রোগ বালাই কম হয়
- পাখির পালক সহজে পড়ে না
- খাচায় নেটের ছিদ্র ছোট বলে ইন্দুর ঢুকতে পারেনা
- ঘন ঘন লিটার পরিষ্কার করার ঝামেলা থাকে না
- খাঁচায় কোয়েল পাখি পালন করলে এমোনিয়া গ্যাস হওয়া সম্ভাবনা খুব কম থাকে।
- পাখি খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়
- দৈহিকভাবে পাখির বৃদ্ধির চাকচিক্য লক্ষ্য করা যায়
খাচায় কোয়েল পাখি পালনের অসুবিধা
খাঁচায় কোয়েল পাখি পালনের সুবিধা যেমন রয়েছে তেমনি অসুবিধা রয়েছে। বিভিন্নভাবে কোয়েল পাখি পালন করে লাভবান হওয়া যায়। তবে কোন ভাবে পালন করা সহজ এবং কোন ভাবে পালন করলে অসুবিধা কম তা জানলে কোয়েল পাখি পালনে উপকৃত হওয়া যায়।
- লোহার খাঁচা তৈরি করতে খরচ বেশি হয়
- বাঁশের খাচা তৈরি করলে বেশি দিন টিকে না
- খাঁচা তৈরির পর খাঁচা রাখার জন্য লিটারের একটি শেড তৈরি করা লাগে তার জন্য আলাদা খরচ করা লাগে
- নিয়মিত খাঁচার ট্রে পরিষ্কার না করলে দুর্গন্ধ ছড়ায়
কোয়েলের বাচ্চা পালনের নিয়ম
সাধারণত কোয়েল পাখির ডিমের তা দেয় না। তাই দিন থেকে কোয়েল পাখির বাচ্চা ফুটানোর মুরগি অথবা ব্রুডার ব্যবহার করতে হবে অথবা। কৃত্রিমভাবে কোয়েল পাখির ডিম ফুটানোর জন্য ১৬ থেকে ১৮ দিন সময় লাগে। সর্বোচ্চ ফলাফলের জন্য প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা আলো প্রয়োজন। ব্রুডারে কোয়েল পাখির বাচ্চা পালন করার জন্য কিছু জিনিস লক্ষ্য রাখতে হবে-
- পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে
- সঠিক বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে
- সঠিক তাপমাত্রায় ব্যবহার করতে হবে
- পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার এবং পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে
- কোয়েলের ঘনত্ব ঠিক রাখতে হবে
- স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে চাষ করতে হবে
ব্রয়লার বা মাংস উৎপাদনকারী কোয়েলের জাত- বাজারে অনেকগুলো মাংস উৎপাদনকারী কোয়েলের ভালো ভালো জাত রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কোয়েলের জাতের নাম হল-
- বব হোয়াইট- আমেরিকান
- হোয়াইট ব্রেস্ট টেড- ভারতীয়
পুরুষ এবং মহিলা কোয়েল পাখি চেনার উপায়
সাধারণত বাচ্চা কোয়েলের ব্যান্ড পরীক্ষা করেই পুরুষ এবং মহিলা কোয়েল পাখি চেনা যায়। তবে সাধারণ পদ্ধতিতে তিন ভাবে পুরুষ এবং মহিলা কোয়েল পাখি চিহ্নিত করা যায়।
বুকের পালক দেখে- সাধারণত পুরুষ কোয়েলের বুকের পালকগুলো হালকা বাদামি রঙের হয়ে থাকে। এবং মহিলা কোয়েল পাখির বুকের পালক কালো রঙের উপর বাদামী রঙের ছিটে দাগ থাকে। দেখতে অনেকটা ফুলের মতো মনে হয়। ২০ দিনের কম বয়সী কোয়েল পাখির পালক দেখে চেনা যায় না। কারণ ২০ থেকে ২৫ দিনে বুকের পালকের রং সবার একই থাকে।
ডাক শুনে- সাধারণত পুরুষ কোয়েল গলা টান করে উচ্চস্বরে ডাকাডাকি করে। তবে কোয়েলের বয়স ৩৫ দিনের বেশি হলেই এরা ডাকাডাকি করে। মহিলা কোয়েল পাখি সাধারণত চুপচাপ থাকে না ডাকাডাকি করে না।
পায়ু পথ দেখে- সাধারণত পুরুষ কোয়েলের পায়ুপথ কিছুটা টিউমারের মত ফোলার মত লক্ষ্য করা যায়। যেখানে চাপ দিলে হালকা সাদা ফেনার মত বের হবে। মহিলা কোয়েলের পায়ুপথ স্বাভাবিক ও প্লেন থাকে। এক্ষেত্রে কোয়েলের বয়স 40 থেকে 45 দিন হতে হবে।
কোয়েল পাখির বাজার
কোয়েল পাখির মাংস এবং ডিম অত্যন্ত সুস্বাদু এবং কম দামে কেনা যায়। তাই অন্যান্য ডিম এবং মাংসের তুলনায় কোয়েল পাখি চাহিদা বেশি বাজারে। কোয়েল পাখি চাষ করলে নিজে সেই স্থানীয় বাজারে কোয়েল পাখির মাংস এবং ডিম বিক্রি করা যায়। তবে কোয়েল পাখি বিদেশে থাইল্যান্ড, জাপান সহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা যায়।
কোয়েল পাখির খাবার
বাজারে কোয়েল পাখির বিভিন্ন ধরনের ফিড বা খাবার পাওয়া যায়। যে সব খাবারের মাধ্যমে কোয়েল পাখির বৃদ্ধি হওয়া নির্ভর করে। তবে বাজারে কিছু ভালো কোয়েল পাখির খাবার হল মূলত তিন ধরনের। সেগুলো হলো স্টার্টার, গ্রোয়ার, লেয়ার। কোয়েল পাখি আকারে ছোট হলেও এর প্রোটিন চাহিদা অনেক বেশি।
- স্টাটার মূলত শূন্য থেকে 22 দিন বয়সী কোয়েল পাখির খাবার
- গ্রোয়ার ২২ দিন থেকে ৫৬ দিন বয়সে কোয়েল পাখির খাবার
- লেয়ার ৫৬ থেকে বিক্রি পর্যন্ত কোয়েল পাখির খাবার খাওয়ানো যায়
কোয়েল পাখির রোগ
কোয়েল পাখির বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়ে থাকে।কোয়েল পাখির বাচ্চা পালন করতে গেলে কোয়েল পাখির রোগ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
- রক্ত আমাশয়
- ক্ষত সৃষ্টিকারী অস্ত্র প্রদাহ
- কৃমির আক্রমণ
- ক্লম্নালি প্রদাহ
- কলি সেফটিমিয়া
- রুডার নিউমোনিয়া
- মারেক্স রোগ
- ক্যানিবালিজম বা ঠোঁকড়া-ঠোকরি রোগ
- কাল টো প্যারালাইসিস
পরামর্শ
কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে কোয়েল পাখি ব্যবসায় অনেক লাভজনক ফলাফল পাওয়া যায়।
- কোয়েল পাখির ঘর সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে
- অসুস্থ কোয়েল পাখিদের থেকে সুস্থ কোয়েল পাখিদের আলাদা করতে হবে
- কোয়েল পাখির জন্য স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে
- সর্বদা আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে
- পরিষ্কার এবং নিরাপদ জল সরবরাহের ব্যবস্থা থাকতে হবে
- অসুস্থ মৃত পাখিকে পুড়িয়ে অথবা মাটির নিচে চাপা দিতে হবে
- অপরিচিত ব্যক্তি বা খামারের নিয়োজিত কর্মী ব্যতীত খামারে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া উচিত নয়
- কোয়েল পাখির ঘর সবসময় শুকনো রাখতে হবে
মন্তব্য
আজকে আমরা কোয়েল পাখির বাচ্চা পালন ও খাঁচায় কোয়েল পাখির বাচ্চা পালন সম্পর্কে একটি আর্টিকেল শেয়ার করেছি। আশা করছি দৈনন্দিন জীবনে এটি অনেক উপকারে আসবে। কোয়েল পাখির বাচ্চা পালন সম্পর্কে আপনাদের কোন মতামত অথবা মন্তব্য থাকলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। আমরা অতি দ্রুত তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করব।
আরো পড়ুন –