গর্ভধারণের সঠিক নিয়ম
গর্ভধারণ একজন নারীর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। গর্ভবতী অবস্থায় মায়েদের কি কি যত্ন নিতে হয় তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু মায়েদের বাচ্চা নেয়ার আগের প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের দেশে খুব কম ই আলোচনা হয়। যার ফলে গর্ভবতী অবস্থায় মা ও সন্তান অনেক সময় জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অথচ গর্ভধারণের সঠিক নিয়ম জানলে এবং গর্ভধারনের পূর্বে একজন নারীর কোন কোন বিষয়ে নজর রাখতে হয় তা জানলে হয়তো এমন সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যেত।
আজকে আমরা বাচ্চা নেয়ার আগের প্রস্তুতি ও গর্ভধারণের সঠিক নিয়ম নিয়ে আলোচনা করব। অর্থাৎ বাচ্চা নেয়ার পরিকল্পনা করার পর থেকে বাচ্চা পেটে আসার পর্যন্ত একজন মায়ের যেসব সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে তা নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো। আশা করছি আজকের পুষ্টি ঐ সকল নারীদের জন্য খুবই উপকার হবে যারা বাচ্চা নিতে চাচ্ছে।
বাচ্চা নেয়ার আগের প্রস্তুতি
জমিতে যেমন ধান চাষ করার আগে থেকেই মাটিকে প্রস্তুত করতে হয় বীজ বপনের জন্য থেকে কিভাবে বাচ্চা নেয়ার পরিকল্পনা করার পর গর্ভধারণের পূর্বে একজন মা হিসেবে কিছু নিয়ম ফলো করে চলতে হয়। যেন পরবর্তীতে বাচ্চা সুস্থ ভাবে পেটে বড় হয়ে উঠতে পারে। বাচ্চা নেয়ার আগের প্রস্তুতি হিসেবে একজন মায়ের এই ১০ টি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত । নিচে আমরা ১০ টি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করছি।
১। শরীরে যথেষ্ট পরিমান ফলিক এসিড প্রয়োজন – একজন নারীর গর্ভধারণের সময় শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে ফলিক এক্সিড থাকতে হয়। সাধারনত আমরা বিভিন্ন খাবার থেকে কিছু পরিমাণে ফলিক এসিড পেয়ে থাকে কিন্তু গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে সেই সামান্য ফলিক এসিড যথেষ্ট নয় তাই অতিরিক্ত ফলিক এসিড ট্যাবলেট এর মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করাতে হয়। আপনি যখন থেকে বাচ্চা নেয়ার পরিকল্পনা করবেন তখন থেকে টানা ১২ মাস ফলিক এসিড ট্যাবলেট গ্রহণ করতে হবে। বাজারে যে ফলিক এসিড ট্যাবলেট পাওয়া যায় তার ১০ মিলিগ্রাম পরিমাণ প্রতিদিন গ্রহণ করতে হবে। তবে আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে সে ক্ষেত্রে পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের সাজেশন থাকবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ফলিক এসিড এর ট্যাবলেট গ্রহণ করুন।
বিশেষ করে আপনার স্বামী কিংবা পূর্বের বাচ্চার যদি মেরুদন্ড বা মস্তিষ্কের সমস্যা থাকে সে ক্ষেত্রে পরবর্তী বাচ্চা গ্রহণের সময় অবশ্যই ফলিক এসিডের ঘাটতি আছে কিনা তা যাচাই করতে হবে এবং বাচ্চা গ্রহণের অনেক আগে থেকেই ফলিক এসিড নেয়া শুরু করতে হবে। তাহলে পরবর্তী আছে সুস্থ হবে এমন আশা করা যায়।
২। কোন টিকা বাদ থাকলে দিয়ে নিন – বাচ্চা গ্রহণের পূর্বে শরীরের রোগ প্রতিরোধের জন্য সম্পূর্ণ ভাবে প্রস্তুত করতে হবে। আপনার যদি কোন টিকা দেয়া বাকি থাকে তাহলে গর্ভধারণের পূর্বে তা সম্পন্ন করুন। বিশেষ করে আপনার যদি হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া না থাকে তাহলে অবশ্যই দিয়ে নিন। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভবতী হওয়ার পর হেপাটাইটিস বি ধরা পড়ে এবং গর্ভের সন্তানের অনেক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়। এতে করে বাচ্চার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। গর্ভধারণের পূর্বে একটি শহর পূর্বের কোন দিকে থাকলে তা দিয়ে নিন।
৩। আয়রনের অভাব আছে কি যাছাই করুন – আয়রনের অভাবে রক্তশূন্যতা দেখা দেওয়া গর্ভবতী নারীদের একটি কমন সমস্যা। তাই গর্ভধারণের পূর্বে আপনার শরীরে আয়রনের ঘাটতি আছে কিনা তা ভালভাবে যাচাই করুন এবং যদি আয়রনের ঘাটতি থাকে তা পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার এবং ওষুধ গ্রহণ করুন। গর্ভবতী মায়ের শরীরে আয়রনের পরিমাণ কম থাকলে বাচ্চা জন্মের সময়ে কম ওজন নিয়ে জন্মাতে পারে এমনকি মৃত বাচ্চার জন্ম।
৪। ভিটামিন ডি এর পরিমান যাছাই করুন – গর্ভধারণের পূর্বে আপনার শরীরে ভিটামিন ডি এর পরিমাণ চেক করতে হবে। ভিটামিন ডি এর পরিমাণ কম থাকলে তা পূরণের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণত নিয়মিত রোদে গেলে শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি পূরন হয়ে যায়। কিন্তু নিয়মিত রোদে না যাওয়া কিংবা গেলেও সমস্ত শরীর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা এমন কিছু কারণে অনেক সময় শরীরে ভিটামিন ডি এর পরিমাণ কমে যায়। এতে করে গর্ভধারণের সময় বাচ্চার পুষ্টিহীনতা নিয়ে জন্মানোর সম্ভাবনা থাকে। তাই গর্ভধারণ করার পূর্বে শরীরে ভিটামিন ঠি না থাকলে অতিরিক্ত ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার এবং ট্যাবলেট খেতে হবে।
৫। অতিরিক্ত ক্যাফেইন পরিহার করুন – আপনার যদি অতিরিক্ত চা-কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকে তাহলে গর্ভধারণের পূর্বে তা কমিয়ে ফেলুন। গবেষণায় দেখা গেছে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত পরিমাণ ক্যাফেইন অর্থাৎ চা-কফি গ্রহণ করলে গর্ভের বাচ্চার যথেষ্ট ক্ষতি হয়। ডাক্তারদের মতে একজন গর্ভবতী নারী দৈনিক সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম ক্যাফেইন গ্রহণ করতে পারেন সে হিসেবে দিনে সর্বোচ্চ দুই কাপ চা বা কফি খাওয়া নিরাপদ। আপনার যদি অতিরিক্ত চা-কফি খাওয়া অভ্যাস থাকে তাহলে এখন থেকে তা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করুন।
৬। স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রন করুন – বাচ্চা নেয়ার আগের প্রস্তুতি হিসেবে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন। অতিরিক্ত ওজন কিংবা অতিরিক্ত চিকন স্বাস্থ্য কোনটি গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত নয়। বিশেষ করে অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অবস্থায় গর্ভধারণ করলে বাচ্চার ডেলিভারির সময় বাচ্চার কষ্ট হওয়াএবং এবং ডেলিভারির পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, সেলাই তৈরি করে শুকনা এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হতো দেখা যায়।
এছাড়া গর্ভবতী মায়ের যদি স্বাস্থ্য কম হয় সে ক্ষেত্রে পুষ্টিহীন বাচ্চা জন্ম হওয়া কিংবা ডেলিভারির সময় মা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা। তাই খেয়াল রাখতে হবে গর্ভকালীন সময়ে স্বাস্থ্য যেন খুব বেশি বা কম না হয়।
৭। স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবার গ্রহন করুন – স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা যেকোনো মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ন। তবে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তখন আপনার শরীর থেকে গর্ভে থাকা বাচ্চা ও পুষ্টি পাবে। তাই আপনি যদি বাচ্চা নেয়ার পরিকল্পনা করে থাকেন তাহলে আজকে থেকেই পুষ্টিকর খাবার এবং সুষম খাবার গ্রহণের চেষ্টা করুন যাতে করে শরীর এখন থেকেই বাচ্চা ধারণ করার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
বাংলাদেশের নারীরা সাধারণত ভাত বেশি পরিমাণে খেতে পছন্দ করেন। যদিও ভাতের চেয়ে সবজি কিংবা ফল বেশি খাওয়া উচিত। তাই আপনি যদি অতিরিক্ত ভাত খাওয়া অভ্যাস থাকে তাহলে তাদের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে সবুজ শাকসবজি ফলমূল এর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করুন এতে করে শরীর সুস্থ ও সতেজ থাকবে।
৮। নিয়মিত শরীর চর্চা করুন – নিয়মিত শরীরচর্চা করার চেষ্টা করুন। এতে করে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং শরীর শক্তিশালী হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করে গর্ভকালীন অবস্থায় ধারণা নারীদের থেকে সুস্থ থাকে এবং ডেলিভারির সময় তাদের কষ্ট কম হয় এবং দ্রুত পূর্বের সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসতে পা্রে। তাই গর্বধারনের পূর্বে নিয়মিত সামান্য হলেও নিয়মিত শরীরচর্চা করার চেষ্টা করুন
৯। ধুমপান এড়িয়ে চলুন – ধূমপান সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলতে হবে। এমনকি আপনার পরিবারের কোনো সদস্যের ধূমপান করে সেটা যদি আপনার নাকে এসে না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখবেন। এতে করে মা এবং সন্তান উভয়ের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
১০। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন – সর্বোপরি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। যাতে এই সময় শরীর কোনভাবে অসুস্থ হয়ে নাম করে কেননা এ সময় আপনি অসুস্থ হবে কবে তাকে বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়বে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে শরীর যেন কোনভাবে অসুস্থ ণা হোয়।
গর্ভবতী মায়ের খাবারের তালিকা
বাচ্চা নেয়ার আগের প্রস্তুতি হীশেবে গর্ভাবস্থায় মায়ের পূষ্টিকর খাবার গ্রহন করতে হবে। বিশেষ করে যারা শুধুমাত্র ভাত খাওয়ার অভ্যাস তারা খাবারের মেনুতে আপনাদের পরিমাণ কমিয়ে বিভিন্ন শাকসবজি ফলমূল এবং ভিটামিনযুক্ত খাবার যুক্ত করতে পারেন। কারন শুধুমাত্র ভাত খেয়ে শরীরে ভিটামিন এবং পুষ্টির চাহিদা পূর্ণ হয়না। তাই গর্ভধারণের পূর্বে শরীরকে করার জন্য প্রস্তুত করতে চাইলে আজকে থেকে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন।
গর্ভবতী নারীদের নিষিদ্ধ খাবার
অনেকেই আমাদের কাছে জানতে চান গর্ভবতী মায়েদের কোন নিষিদ্ধ খবর আছে কিনা। এমন কোন খাবার আছে কিনা যায় গর্ভবতী মায়েরা খেতে পারবেন না। ডাক্তার গর্ভবতী মায়েদের সব রকম পুষ্টিযুক্ত খাবার খেতে বলেন এমন কোন স্পেশাল খাবার নেই যে গর্ভবতী মায়েরা খেতে পারবেন না। তবে গর্ভধারণ অবস্থায় খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিতে হবে যাতে কোনভাবে গ্যাস্ট্রিক সমস্যা না হয় কিংবা ডায়রিয়া হলে সমস্যা না হয় এবং খাবারের পুষ্টিগুণ যেন ভাল হয়। এ সময় শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে আয়রন ভিটামিন এর প্রয়োজন হয় এমন খাবার গ্রহণ করতে হবে যে শরীরের সব রকম চাহিদা পূর্ণ করে। ডুবো তেলে ভাজা খাবার অতিরিক্ত ঝাল খাবার কিংবা অতিরিক্ত মসলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। কেননা এগুলো শরীরের ক্ষতিকর এবং হজমশক্তিও কমিয়ে দেয়।
গর্ভবতী মায়ের ঘুমানোর নিয়ম
গর্ভাবস্থায় ঘুমানোর পদ্ধতি নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আসে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে গর্ভাবস্থায় উপর চিৎ হয়ে শোয়া সম্পূর্ণ অনুচিত অর্থাৎ পেটের উপর ভোট দিয়ে ঘুমানো উচিত নয় সবচেয়ে ভালো ঘুমানোর পদ্ধতি হচ্ছে কাত হয়ে শোয়া অর্থাৎ ডান অথবা বাম কাত হয়ে ঘুমানো বিশেষজ্ঞদের মতে বাম কাত হয়ে ঘুমানো সবচেয়ে ভালো এতে করে শরীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং তুলনামূলক একটু উঁচু বালিশ আমারও দেয়া উচিৎ
আরো পড়ুন – বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত বয়স । প্রথম বাচ্চা নেওয়ার সঠিক সময়
গর্ভধারণের সঠিক নিয়ম
উপরে বাচ্চা নেয়ার আগের প্রস্তুতি ও খাবারের তালিকা – গর্ভধারণের সঠিক নিয়ম নিয়ে আলোচনা করেছি। আশা করছি গ্রহটি আপনাদের কিছুটা হলেও উপকারে এসেছে ব্লগ টি ভাল লাগলে আপনারা আত্মীয়কেও প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করতে পারেন। এবং আমাদের ওয়েবসাইটের অন্যান্য পোস্টগুলো পড়তে পারেন আমরা নিয়মিত স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন পোস্ট করার চেষ্টা করে থাকি।