জরায়ু টিউমারের লক্ষণ
বাচ্চা নিতে আগ্রহী এমন মহিলাদের বর্তমানে যে সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণে দেখা যায় তা হচ্ছে জরায়ুর টিউমার এর সমস্যা। গবেষণায় দেখা গেছে বর্তমানে ৩০ বছর উর্ধের ২০ শতাংশ মহিলাদের জরায়ুর টিউমার সমস্যাটি হয়ে থাকে। শুরুর দিকে এই রোগটি তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়ায় বেশিরভাগ নারী প্রথম অবস্থায় বুঝতেই পারেন না তার টিউমার হয়েছে কিনা। আর দেরি করার ফলে এমন ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন তৈরি হয় যা পরবর্তীতে অপারেশন ছাড়া হাতে কোন অপশন থাকেনা।
আজকে আমরা মূলত জরায়ু টিউমারের লক্ষণ, জরায়ু টিউমার অপারেশন খরচ ও টিউমার প্রতিকারের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আশা করছি আজকের আলোচনাটি সবার অনেক উপকারে আসবে বিশেষ করে যেসব মায়েরা গর্ভ ধারণ করার পরিকল্পনা করছেন তাদের জন্য আজকের ব্লগটি খুবই উপকারী হতে পারে। কারণ শুরু থেকেই সচেতন থাকলে রোগটির প্রথমেই নিয়ন্ত্রণে করা যায় এবং অল্প থাকতেই চিকিৎসা করালে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
জরায়ু টিউমার
নারীদের জরায়ু নরম পেশি দিয়ে তৈরি। শারীরিক কোন জটিলতার কারণে নরম পেশিগুলো অতিরিক্ত পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে টিউমার তৈরি হয়। জরায়ুর টিউমার কি ফাইব্রয়েড বলা হয়। এটাই খুবই কমন এবং স্বাভাবিক একটি রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ অন্যান্য বিভিন্ন রোগের মত এটি জরায়ুর খুবই সাধারন একটি রোগ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক জটিলতার কারণে গর্ভধারণের সময় এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে 30 বছরের বেশি বয়সী ২০ শতাংশ নারীর এই সমস্যা হয়ে থাকে।
জরায়ু টিউমার প্রধানত তিন প্রকার হয়ে থাকে সাব সেরাস, ইন্ট্রা মুরাল এবং সাব মিউকাস। এরমধ্যে সাবমিউকাস ধরনের টিউমারটি সবচেয়ে জটিল এবং মারাত্মক। গর্ভধারণের পূর্বে টিউমার ধরা পড়লে কোন চিন্তার কারণ নেই কারণ বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নিলে খুব সহজেই টিউমারের রোগটি প্রতিরোধ করা যায়। তবে শুরুতেই টিউমারের চিকিৎসা ভালোভাবে না করলে গর্ভধারণের পরে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে এবং পরবর্তীতে ক্যান্সারের মতো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। তাই জরায়ু টিউমারের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
জরায়ু টিউমার কেন হয়
জরায়ু টিউমারের লক্ষণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে আমাদের জানতে হবে জরায়ুর টিউমার কেন হয়। জরায়ুতে টিউমার কেন হ্য এর সঠিক কারণ ডাক্তারদের এখনো অজানা। তবে যেসব কারণে জরায়ুর টিউমার হতে পারে সঠিকভাবে বোঝা না গেলেও ডাক্তাররা কিছু সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করেন।
বেশি বয়সে বাচ্চা নেয়া – আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ২৫ থেকে ২৬ বছর বয়সে বিয়ে করেন এবং লম্বা সময় গ্যাপ দিয়ে ৩০ বছরের পরে বাচ্চা নেয়ার চেষ্টা করেন। এবং মাঝে এই পুরো চার পাচ বছর বিভিন্ন ইনজেকশন ও পিল খেয়ে বাচ্চা নেয়া থেকে বিরত থাকেন যা নারীর শরীরের ক্ষতির সৃষ্টি করে। এরপর যখন বাচ্চা নেয়ার চেষ্টা করেন তারপর জরায়ুর টিউমারের মতো জটিল বিষয়ে তৈরি হতে পারে।
লম্বা সময় ক্যাপ দিয়ে বাচ্চা নেয়া – জরায়ু টিউমারের প্রধান আরেকটি কারণ হতে পারে লম্বা গ্যাপ দিয়ে বাচ্চা নেয়া। অর্থাৎ অনেকেই আছেন যারা একটি বাচ্চা নেয়ার পরে অনেক বছর গ্যাপ দিয়ে আবার বাচ্চা নেয়ার চেষ্টা করেন সেক্ষেত্রে তাদের জরায়ু টিউমারের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
ইস্ট্রোজেন হরমোন – নারীদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন ইস্ট্রোজেন হরমোন। এটি নারীদের শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন এবং সুস্থ রাখার জন্য কাজ করে থাকে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বাইরে থেকে এস্ট্রোজেন হরমোন নিয়ে থাকেন যার ফলে জরায়ু টিউমারের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কেননা জরায়ু টিউমার একটি এস্ট্রোজেন হরমোন নির্ভর টিউমার শরীরে হরমোনের পরিমাণ বেড়ে গেলে জনিত টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
স্থুলতা ও জিনগত কারনে – শারীরিক সমস্যার কারণে জরায়ুর টিউমার হতে পারে অর্থাৎ আপনার শরীরের মেয়েদের চর্বির পরিমাণ যদি অত্যাধিক পরিমাণে হয় অথবা পূর্বে আপনার মা খালা কারো জরায়ু টিউমার থেকে থাকে সে ক্ষেত্রে জিনগতভাবে আপনার শরীরে জরায়ু টিউমারের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
জরায়ু টিউমারের লক্ষণ
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জরায়ু টিউমারের লক্ষণ প্রকাশ করা ছাড়াই থাকে অর্থাৎ এই টিউমারটি শুরুতে তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা আলট্রাসনো করাতে এসেছি টিউমার এ কথা জানতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থায় মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে এটি এমনিতেই ভালো হয়ে যায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না।
তবে টিউমারের আকার বেশি বড় হয়ে গেলে এবং শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করলে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। অভিজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করলে জরায়ু টিউমারের লক্ষণ ও শারীরিক অবস্থা দেখে ডাক্তার বিভিন্ন রকম ওষুধ দিয়ে থাকেন। তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই ভালো মানের অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে পরামর্শ নিতে। হবে যদিও তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না তাও আমরা চেষ্টা করছি সম্ভাব্য লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করবো।
- অনিয়মিত ঋতুস্রাব জরায়ু টিউমারের লক্ষণ এর সবচেয়ে বড় লক্ষন গুলোর মধ্যে একটি। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় পরপর সঠিকভাবে মাসিক না হওয়া জরায়ু টিউমারের লক্ষণ গুলোর মধ্যে একটি।
- আরেকটি লক্ষণ হতে পারে নির্দিষ্ট সময় পর মাসিক হলেও প্রতিবার মাসিকের স্থায়িত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া এবং অতিরিক্ত রক্তপাত ও ব্যথা অনুভব হওয়া।
- তলপেট ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা করা।
জরায়ু ঘা হলে করণীয়
সাধারণত যাদের অতি অল্প বয়সে বিয়ে হয় কিংবা অল্প বয়সে অধিক পরিমাণে বাচ্চা নেয় তাদের অনেকেরই জরায়ুতে ঘা হয়ে যেতে পারে। যা ভালোভাবে চিকিৎসা না করলে পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে তাই জরায়ুতে ঘা অনুভব হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে গাইনি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে এবং পরামর্শ অনুযায়ী ভালো চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। বলে রাখা ভাল জরায়ুতে ঘা হচ্ছে জরায়ু টিউমারের লক্ষণ গুলোর মধ্যে একটি। জরায়ুতে ঘা অনুভব হলে দেরি না করে অবশ্যই দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাক্তারের সাথে দেখা করতে হচ্ছে।
জরায়ু টিউমার অপারেশন খরচ
বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি দুইভাবেই জরায়ু অপারেশন করানো যায়। তবে শুরুর দিকে ডাক্তাররা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন অপারেশন ছাড়া কোন ভাবে টিউমার থেকে নির্মূল করা যায় কিনা। জরায়ু টিউমারের লক্ষণ দেখে ডাক্তার ডিসিশন নিবেন অপারেশন করানো লাগবে কি না। যদি টিউমারের অবস্থান এমন হয়ে যা আপনার তেমন ক্ষতি করবে না তাহলে আজকে অপারেশন না করার পরামর্শ দিবেন। কেননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপারেশনের পরে জরায়ু ফেলে দিতে হয় অথবা গর্ভ ধারণ ক্ষমতা চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। তাই অপারেশন করার পূর্বে অভিজ্ঞ ডাক্তার ও ভালো হসপিটালে থেকে পরামর্শ নিন।
সরকারি হসপিটালে জরায়ু টিউমার অপারেশন করাতে আপনার খরচ পড়বে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মতো এবং বেসরকারি হসপিটালে জরায়ু টিউমারের অপারেশনের খরচ ১ লক্ষ টাকা বা তার বেশি পড়ে যাবে। তবে আপনি যদি আরেকটু ভালোভাবে অপারেশন করতে চান সেক্ষেত্রে ভারতের হসপিটালে গিয়ে চিকিৎসা করতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার খরচ ২ লক্ষ টাকা বা তার একটু বেশি হবে।
জরায়ু টিউমার অপারেশনের পর করণীয়
জরায়ু অপারেশনের পর আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে এবং ভারী জিনিস উত্তোলন থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। জরায়ু টিউমারের লক্ষণ এর উপর নির্ভর করে খাবার গ্রহনের সময় আপনাকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তুলনামূলক শক্ত ও হযরত হজম হতে সমস্যা হতে পারে এমন খাবার সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলতে হবে। এছাড়াও ঝাল জাতীয় খাবার ও ডুবো তেলে ভাজা পোড়া খাবার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ আপনার জন্য। এছাড়াও পরবর্তীতে শারীরিক মিলনের সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং সর্বোপরি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আপনাকে বাকি সম্পূর্ণ জীবন বার করতে হবে।
জরায়ু টিউমারের হোমিও চিকিৎসা
অনেকেই অপারেশন করানোর ভয় হোমিও ঔষধ গ্রহন করার মতো সিদ্ধান্ত নেন। হোমিও অনেক চিকিৎসক দাবি করেন অপারেশন ছাড়াই জরায়ুর টিউমার সম্পূর্ণরূপে ভালো করা সম্ভব যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত নয়। আমাদের সাজেশন থাকবে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন ডাক্তার জরায়ু টিউমারের লক্ষণ দেখে প্রয়োজনীয় সাজেশন দেবেন এবং ডাক্তার যদি বলেন অপারেশন করাতে হবে সে ক্ষেত্রে আমাদের সাজেশন থাকবে অতিরিক্ত চিন্তা না করে দ্রুত অপারেশনের ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় এটি জরায়ু ক্যান্সার আকারে ধারণ করবে পরিনাম একমাত্র মৃত্যু।
জরায়ু টিউমার প্রতিরোধের উপায়
যেহেতু জরায়ু টিউমারের লক্ষণ প্রকাশ সাধারণত দেরি করে পায়। তাই ৩০ বছরের পর যারাই গর্ভধারণের পরিকল্পনা করবেন তারা গর্ভধারণের পূর্বে অবশ্যই আলট্রাসনোগ্রাফি করার মাধ্যমে জরায়ুর অবস্থা ভালোভাবে চেক করে নেবেন। যদি জরায়ুতে টিউমার বা কোনরকম সমস্যা চোখে পড়ে আগে চিকিৎসা করে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে নিন তারপর গর্ভধারণের চেষ্টা করুন অন্যথায় চিকিৎসা করা অনেক জটিল হয়ে যাবে।
এছাড়া মাঝে মাঝে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং শারীরিক চেকআপ করার মাধ্যমে জরায়ুর অবস্থা সম্বন্ধে জেনে নিন আর যদি কোন সমস্যা ধরা পড়ে সাথে সাথে জরায়ু টিউমারের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা নিন।
উপরে আমরা জরায়ু টিউমারের লক্ষণ, জরায়ু টিউমার অপারেশন খরচ ও হোমিও চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি আশা করেছি। আশা করছি ব্লগটি গর্ভধারণ করবেন এমন মায়েদের অনেক উপকারে এসেছে। আমরা ওয়েবসাইটে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন রকম পোস্ট নিয়মিত করে থাকি। পোস্টটি ভাল লাগলে আমাদের ওয়েবসাইটের অন্যান্য ব্লগ গুলো অনুরোধ করছি। এছাড়াও আপনার আত্মীয়র কিংবা প্রিয়জনের সাথে আমাদের এই ব্লগে শেয়ার করতে পারেন এবং এই পোস্ট রিলেটেড কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ